ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস ২০২৫

পূর্ণ যৌবনে ফিরবে না তিস্তা, মরুকরণে ভাসবে ধরলা

রিপন ইসলাম শেখ, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১৭ জুন ২০২৫

পূর্ণ যৌবনে ফিরবে না তিস্তা, মরুকরণে ভাসবে ধরলা

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

আজ বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। অথচ দিনটি বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চলের জন্য যেন এক নির্মম বিদ্রূপ। বিশ্বের মরুকরণ প্রবণ অঞ্চলগুলোর মতোই ক্রমেই পানিশুন্য ও প্রাণহীন হয়ে পড়ছে তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা। তিস্তা নদীর অস্তিত্ব সংকট এখন শুধু পানি সংকট নয়-এটি একটি পরিবেশগত বিপর্যয়, একটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, এবং একটি মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু স্বাধীনতার আগেই। ১৯৮৩ সালের সমঝোতায় বাংলাদেশকে ৩৬ শতাংশ এবং ভারতকে ৩৯ শতাংশ পানি বরাদ্দের কথা থাকলেও বাস্তবে ভারত একতরফাভাবে নদীর উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে প্রায় সম্পূর্ণ পানি নিজেরাই দখলে রেখেছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনকে অগ্রাহ্য করে নদীর ৫৪টি জলকপাটের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সেচ প্রকল্পে।

ভারত বাংলাদেশের ৬০ কিলোমিটার উজানে ২০২৩ সালের ২ মার্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেচ বিভাগ তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের অধীনে আরও দুটি খাল খননের কাজ শুরু করতে চলেছে। যা রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলায় আরও বেশি জমিতে সেচের আওতায় আনতে সাহায্য করবে এই প্রকল্প। আর এরেই নির্দেশনা দিয়ে মমতার সরকার যার ফলে তিস্তার পানি গিয়ে ভারতে দিনাজপুরের জলঢাকা নদীর সঙ্গে মিলিত হবে। ভারতে জলঢাকা নামে পরিচিতি লাভ করলেও বাংলাদেশে তা ধরলা নদী নামে পরিচিতি পেয়েছে। বর্ষাকালে ধরলায় দেখা দিতে পারে ভয়ানক বন্যাও, আর শুষ্ক মৌসুমে হতে পারে বিশাল মরুভূমি।

ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের পতন ও কৃষির মৃত্যু: একসময় সাত লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করা তিস্তা এখন আর ৪০ হাজার হেক্টর জমিতেও পানি দিতে পারছে না। ফলে শ্যালো ও গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে বহুগুণে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩-৪ মিটার পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে। তিস্তা অববাহিকার নদ-নদী যেমন করতোয়া, ধরলা, যমুনাশ্বেরী, কুমলাই, পুনর্ভবা শুকিয়ে গেছে। নদী হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে মাছ, নৌকার মাঝি, নদীভিত্তিক পেশাজীবী শত শত পরিবার। বন, কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যের অবস্থা ভয়াবহ। মরুকরণ এখন আর শুধু সাহারার গল্প নয়-এটি বাংলার বাস্তবতা।

গজলডোবা বাঁধের কারণে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। সাহারা মরুভূমির গবেষক মার্কিন ভ‚বিজ্ঞানী ড. নরম্যান ম্যাকলিয়ড বলেছেন, ‘সাহারাতে ঠিক যেভাবে একদিন মরুভূমির বিস্তার শুরু হয়েছিল, বরেন্দ্র এলাকায় ঠিক সেভাবেই বিপদটা শুরু হয়েছে’। গজলডোবার কারণে তিস্তাসহ অনেক ছোট নদ-নদীতে বছরের প্রায় ৮ মাসই পানি থাকে না। নদীর পলি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নীচে নেমে যাচ্ছে। 

শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলার প্রকৃতি ও পরিবেশ রীতিমতো বদলে যাচ্ছে। একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের জীবন ও জীববৈচিত্র্যই কেবল ধ্বংস করেনি; বরং ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে এ দেশের কৃষি, শিল্প, বনসম্পদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য। হঠাৎ বন্যার কারণে কোথাও কোথাও নদী প্রসারতা ৪-৫ কিলোমিটার প্রসস্থ হয়েছে।

গজলডোবা বাঁধ: মরণফাঁদ
উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবজীবনের উপর গজলডোবা বাঁধের প্রভাব এতটাই ভয়াবহ যে একে স্থানীয়রা বলছে "মরণ বাঁধ"। এটি শুধু পানি আটকে রাখছে না; এটি ধ্বংস করছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, পরিবেশগত ভারসাম্য ও মানুষের জীবিকা।

মরুকরণ রোধে করণীয়
বিশ্বব্যাপী আজ যখন মরুকরণ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজের ডাক দেয়া হচ্ছে, তখন আমাদের করণীয় হতে পারে: উজানের কোন দেশ ভাটির দেশকে না জানিয়ে আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার করা জাতিসংঘ কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ ভারত প্রথম থেকেই ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে বিশ্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এ কাজটি করে যাচ্ছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে। এক্ষণে এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের করণীয় হচ্ছে-

১. গজলডোবা অশুভ প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক জনমত এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। কাদা ছোড়াছুড়ির বিভেদাত্মক রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় স্বার্থে সরকার, বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এ সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২. গজলডোবা কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়-ক্ষতির কথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা। প্রয়োজনবোধে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের দ্বারস্থ হওয়া।

৩. চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পানি সমস্যার সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা। সাথে সাথে এ লক্ষ্যে ‘আঞ্চলিক নদী কমিশন’ গঠন করা ও আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের নিয়ম-নীতির বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো ও তদারকি করা।

৪. দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতকে চাপ প্রয়োগ করা, যাতে ভারত তার নব পরিকল্পিত একতরফা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ বাতিল করে।

৫. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। মেকং নদী কমিশনের মতো বাংলাদেশও একটি কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। মেকং নদীর পানি কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনাম সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করে নিচ্ছে। 

একটা তিস্তা মানে এক টুকরো বাংলাদেশ: তিস্তা যদি শুকায়, বাংলাদেশ শুকায়। নদীর মৃত্যু মানে শুধু পানি হারানো নয়, তা হলো একটি জাতির প্রাণ চক্রে আঘাত। বিশ্ব মরুকরণ প্রতিরোধ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক বলে জানিয়েছেন তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী।

নোভা

×