
ছবি: জনকন্ঠ
যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় অবস্থিত ‘শাহমান্দারতলা’ নামের একটি স্থানে শত শত বছর ধরে পাশাপাশি ধর্মচর্চা করে আসছেন হিন্দু ও মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা। প্রায় ৮০০ বছর পুরোনো এই পবিত্রস্থানে নেই কোনো বিভাজনের দেয়াল, নেই কোনো বাধা-বিপত্তি—শুধু বিশ্বাস, ভক্তি আর সম্প্রীতির নিঃশব্দ মিলন।উপজেলার কাটাখালি, ভোমরদাহ, নলডাঙ্গা, হাজিরহাটসহ কয়েকটি গ্রাম বেষ্টিত ডুমুরবিলের কোলঘেঁষে ও মুক্তেশ্বরী নদীর পাড়ে অবস্থিত এই স্থানটি এখন পরিচিত দুই ধর্মের মিলনস্থল হিসেবে।
স্থানীয়রা মনে করেন, মুসলিমদের কাছে এটি পীর-আউলিয়ার তীর্থস্থান, আর হিন্দুদের কাছে এটি পূজার পবিত্রস্থল। যুগের পর যুগ ধরে সব ধর্মের অনুসারীরা যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মানত করেন, প্রার্থনা করেন, দান করেন, আশ্রয় খোঁজেন। বিশ্বাস রয়েছে—সন্তানহীন দম্পতিরা সন্তান লাভের আশায়, রোগ-ব্যাধি বা মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আসেন এ স্থানে। বটগাছের নিচে বসে গামছা বা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বসেন নারী-পুরুষ। যদি বটগাছ থেকে কোনো ফুল বা পাতা পড়ে, সেটিকে মানত পূরণের লক্ষণ বলে ধরে নিয়ে আশার প্রতীক হিসেবে ইট ঝুলিয়ে প্রার্থনা করেন। মানত পূরণ হলে কেউ দান করেন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি কিংবা নগদ অর্থ। এই স্থানের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন ও কিংবদন্তিময়।
স্থানীয় হরিদাসকাটি গ্রামের অশীতিপর সুভাষ মণ্ডল ও কাটাখালি গ্রামের নূর ইসলাম সরদার জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা গল্প অনুযায়ী, বহু বছর আগে এই জায়গায় এক সাধক পুরুষ—‘শাহমান্দার’—বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে খোদাভক্ত ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। জঙ্গলে ঘেরা বিপদসংকুল এলাকাকে তিনি ধ্যানমগ্ন সাধনার মাধ্যমে পবিত্র করেছিলেন বলে বিশ্বাস। একদিন হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সেই থেকেই তাঁর স্মৃতিতে এ স্থানটি হয়ে ওঠে লোকবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু।
স্থানীয়দের ধারণা, বার শতকের শুরুর দিকে ইরান, ইয়ামেন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম প্রচারে আসা পীর-দরবেশদের মধ্যে শাহমান্দার ছিলেন একজন। তিনি স্থানীয়দের মধ্যে মানবতা, প্রেম ও ভক্তির বাণী প্রচার করেন। গত ৩০ বছর ধরে এ স্থানটির দেখভাল করছেন গণেশ গোসাই। তার আগেও কার্ত্তিক গোসাইসহ আরও অনেকেই এই ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে।
এক কথায়, শাহমান্দারতলা এখন শুধুই একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক আলোকবর্তিকা—যেখানে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ এক হয়ে দাঁড়ায় প্রার্থনায়, ভালোবাসায়, বিশ্বাসে।
Mily