
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থান রয়েছে, যা অনেকেরই অজানা। আবার জানা থাকলেও অনেকেই সেখানে যেতে পারেনি। এরমধ্যে রয়েছে সাচারের জগন্নাথ দেবের রথ, মনসামুড়া মন্দির, উজানীর বেহুলা-লক্ষীন্দরের পাটা-পুতার দিঘি আর চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া সাম্পান ইত্যাদি। এসব ধর্মীয় স্থান কচুয়া উপজেলায় বহুকাল ধরেই রয়েছে। মনসামুড়াটি এখনো বেহুলা-লক্ষীন্দরের কালের সাক্ষী হয়ে উপজেলার মেঘদাইর গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কচুয়া বাজার থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে গৌরিপুর-কচুয়া-হাজীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে সাচার ইউনিয়ন পরিষদ। এই ইউনিয়নের সাচার বাজারে জগন্নাথ দেবের মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে বহুকাল ধরেই আষাঢ়ের জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রার প্রতিমূর্তি স্থাপন করে প্রথম রথ ও ফিরতি রথ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বৎসরও আগামী ২৭শে জুন, শুক্রবার, আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে এবং উল্টো রথ আগামী ৪ঠা জুলাই, শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে বলে পঞ্জিকা মতে জানা গেছে।
এই রথে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত থেকে এসে অসংখ্য ভক্ত সমাগত হন। আষাঢ় আসলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় সাচারে। আর দ্বিতীয় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ে। এই রথযাত্রায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত থেকে অনেক ভক্ত সাচারে এসে থাকেন। এটি বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে সাচারের রথটিতে দাপর, ক্রেতা ও কলিযুগের বহু নিদর্শন কাঠের খোদাই করা নকশা শোভা বর্ধন করেছিল। কিন্তু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা সৌন্দর্য মণ্ডিত সাচারের রথটি পুড়িয়ে দেয়।
পোড়া ধ্বংসাবশেষ নিয়ে স্বাধীনতার পর রথটি টানা হতো। এখনো আষাঢ়ের রথ যাত্রায় সাচারে কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম ঘটে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তরা সাচারের রথটিকে তাদের পূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে মনে করেন। তাই তারা রথযাত্রা এলে সাচারের জগন্নাথ মন্দিরে ছুটে আসেন। সাচার জগন্নাথ মন্দিরটি ঘিরে আরও ৩টি মন্দির রয়েছে। এগুলো হলো—দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির এবং কালী মন্দির।
সাচার জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত দীপক চক্রবর্তী জানান, ১২৭৭ বঙ্গাব্দে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচারের রথের প্রতিষ্ঠা। এই উৎপত্তির পর থেকে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচারের জগন্নাথ মন্দিরে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে রথযাত্রা উদযাপিত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়া রথটি তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আনম এহছানুল হক মিলন নতুনভাবে নির্মাণ করে দেন। যার ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আনম এহছানুল হক মিলনের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, আমি একবার মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের রথে গিয়েছিলাম। ওই রথটি আমায় মুগ্ধ করেছে। যার জন্য আমি সাচারের রথটি পুনরায় নির্মাণের জন্য ভারত থেকে কারিগর এনে তৈরি করেছি। সারাদেশের হিন্দু ধর্মীয় মানুষ এখানে তাদের ধর্মীয় পূজা অর্চনা করে থাকেন। আমি চেয়েছিলাম এটিকে হিন্দুদের মহা তীর্থস্থান করতে। যারা মন্দিরের জায়গা দখল করেছে, তা উদ্ধার করতে চেয়েছিলাম। এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। যার জন্য ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে প্রথমে ২০ লাখ টাকায় এটির নির্মাণ শুরু করি। পরবর্তীতে এটি ৪০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। শুধু তাই নয়, রথটি রাখার জন্য ঘর নির্মাণে ২২ বান ঢেউটিন দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে ১১ জন দুস্থ পরিবারকে টিন দেয়া হয়। তারা এই টিনগুলো মন্দিরে দান করে দেন। সাচার জগন্নাথ মন্দিরটি এখন নিজস্ব অর্থ ও বিভিন্ন জনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জগন্নাথ মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটিও করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সাচারের রথযাত্রা উৎসবটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি মিলনমেলাও বটে। রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষেরা একত্রিত হন এবং এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
মিমিয়া