ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

ঐতিহ্যের স্মারক ঈশা খাঁ থেকে রূপপুরের ’গ্রীন সিটি’: ঈশ্বরদীর এক নতুন দিগন্ত

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী, পাবনা

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ১৭ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:০৭, ১৭ জুন ২০২৫

ঐতিহ্যের স্মারক ঈশা খাঁ থেকে রূপপুরের ’গ্রীন সিটি’: ঈশ্বরদীর এক নতুন দিগন্ত

ছবিঃ সংগৃহীত

দেশের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত পাবনা জেলার ঈশ্বরদী, এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ যা কালের পরিক্রমায় নানা পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর স্মৃতি-বিজড়িত এই ভূমি, আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা "গ্রীন সিটি" এলাকাটি ঈশ্বরদীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি-কালচার এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে।

ঈশা খাঁর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার: ঈশ্বরদীর মাটিকে ইতিহাসের সাথে বেঁধে রেখেছে মুসলিম বীর ঈশা খাঁর নাম। যদিও তার মূল জমিদার বাড়ি ছিল সোনারগাঁওয়ে, বাংলার বারো ভূঁইয়াদের এই প্রতাপশালী নেতা বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় মুঘলদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। তার বীরত্ব, স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস আজও এই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। ঈশ্বরদীর মানুষ ঈশা খাঁর সেই আত্মমর্যাদাবোধ ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, যা তাদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ঈশ্বরদীর ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-কালচার: ঈশ্বরদী মূলত একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কৃষিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। মাঠে মাঠে ধান, গম, আখ, সবজি এবং বাগানগুলোতে লিচু, আমসহ বিভিন্ন ফলের সমারোহ এখানকার চিরচেনা দৃশ্য। এখানে রয়েছে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর প্রধান কার্যালয়, ডাল ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এখানে শুধু কৃষিতেই রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক রয়েছেন ১৬ জন। এখানকার অধিবাসীরা শান্তিপ্রিয় এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। নকশী কাঁথা ও বেনারসী শাড়ি তৈরিতে এখানকার কিছু মহিলার অবদান আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছে। কৃষিভিত্তিক এই সমাজে লোকগীতি, পালাগান, গ্রামীণ মেলা ও উৎসবগুলো কৃষ্টি-কালচারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় অফিস ও জংশন হিসেবেও ঈশ্বরদীর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ঈশ্বরদীতে ইপিজেড রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে এখানকার অর্থনীতি ও যোগাযোগের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: এক টুকরো রাশিয়া, 'গ্রীন সিটি'র উন্মোচন: ঈশ্বরদীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মিত দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেবল বাংলাদেশের জ্বালানি খাতেই বিপ্লব আনছে না, বরং ঈশ্বরদীর ভূ-প্রকৃতি ও জনজীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। দেশের এই মেগা প্রকল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা আধুনিক আবাসন এলাকা, যা 'গ্রীন সিটি' নামে পরিচিত, তা যেন ঈশ্বরদীর বুকে এক টুকরো রাশিয়ার প্রতিচ্ছবি। দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিদেশি প্রকৌশলী ও কর্মীদের উপস্থিতি এখানকার কৃষ্টি-কালচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রীন সিটিতে রাশিয়ান ও অন্যান্য দেশের মানুষের বসবাস, তাদের জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস এবং বিনোদন এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিতে ভিন্নতা এনেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে।

ভবিষ্যৎ কৃষ্টি-কালচার ও আগামীর সম্ভাবনা: রূপপুর প্রকল্পের কারণে ঈশ্বরদীর ভবিষ্যৎ কৃষ্টি-কালচারে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আশা করা যায়। গ্রীন সিটি এলাকার আধুনিক জীবনযাত্রা স্থানীয়দের প্রভাবিত করবে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এই এলাকার সামগ্রিক মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, যা তাদের রুচি ও পছন্দের পরিবর্তন আনবে। স্থানীয় কৃষি ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পাশাপাশি নতুন নতুন পেশা ও শিল্পের বিকাশ ঘটবে।

তবে, এই পরিবর্তনের সাথে স্থানীয় কৃষ্টি-কালচারের মৌলিকত্ব রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখা এবং একই সাথে বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া উভয়ই জরুরি।

উপসংহার: ঈশা খাঁর স্মৃতিধন্য ঈশ্বরদী আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এর গ্রীন সিটি ঈশ্বরদীকে আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দিয়েছে। এই পরিবর্তন ঈশ্বরদীর অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সামাজিক জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধারণ করে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঈশ্বরদী এক সমৃদ্ধ ও বিকশিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন এক অনন্য কৃষ্টি-কালচারের জন্ম দেবে।

ইমরান

×