ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং বাংলাদেশে আসন্ন প্রভাব

অর্ঘ্য প্রতীক চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বিইউপি

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৯ জুন ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং বাংলাদেশে আসন্ন প্রভাব

মধ্যপ্রাচ্যের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রত্যক্ষ হুমকিস্বরূপ। ইরান ইসরায়েলের সামরিক সংঘাত শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।  সাম্প্রতিক কালের এই সামরিক সংঘাতের প্রধান কারণ হলো ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় দ্রুত আগ্রাসন, যা ইসরাইল ‘Operation Rising Lion’ নামে ১৩ জুন  নিকটসীমায় নিয়ন্ত্রণপ্রাপ্ত লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের হামলা চালায়। ইসরাইল ন্যাটানজ, তাবরিজ, তেহরানসহ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় বিমান ও ড্রোন স্ট্রাইক চালিয়ে উচ্চপদস্থ সামরিক শীর্ষকর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে। 

ইরান প্রতিশোধ হিসেবে সহস্রাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যার মধ্যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে; এতে ইরানি নিহত ৪০০–৫৮৫ ও ইসরায়েলের নিহত ২৪ রেকর্ড করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে ইসরাইলে এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।

গত ১৭ জুন ইসরাইলি মন্ত্রিসভা ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও কৌশলগত সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে, যা সংঘাতকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এর আগে, ইসরাইল ইরানি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের টার্গেটেড হত্যা চালালে ইরান সরাসরি প্রতিশোধমূলক হামলার ঘোষণা দেয়। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ্ খামেনি কঠোর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়ছে৷ গত তিন দিনে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ইউরোপের কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটির উদ্দেশে উড়ে গেছে অন্তত ৩০টি যুদ্ধবিমান। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ট্র্যাকিং সংস্থা ফ্লাইটরাডার ২৪ এর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।

বিবিসির নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেসি-১৩৫ নামের এই বিমানগুলো নামে যুদ্ধবিমান হলেও সাধাররণত এগুলোকে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় না। এগুলো মূলত ট্যাংকার বিমান; অর্থাৎ অপারেশনে ব্যবহৃত যুদ্ধ ও বোমাবাহী বিমানগুলোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা কেসি-১৩৫ বিমানগুলোর কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ” দাবি করেন এবং আকাশের নিয়ন্ত্রণে মার্কিন হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেন। 

তবে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এলাকায় তেল ও অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে ।এই উত্তেজনার পুরো কূটকৌশল নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যারা একদিকে ওমানের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালাচ্ছে, অন্যদিকে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। 

 সংঘাতের বিস্তৃত পরিসর

এই সংঘাত এখন ইরান-ইসরাইল সীমান্ত ছাড়িয়ে সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছে, যার জবাবে ইসরাইলি বিমান হামলায় সংগঠনের তিন সদস্য নিহত হয়েছেন। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরাইলি জাহাজ লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলো নিরাপত্তার কারণে লোহিত সাগর এড়িয়ে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ ঘুরে চলাচল করছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে।

অর্থনীতিতে চার স্তরের আঘাত

১. জ্বালানি সংকট:
ইরানে হামলার আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ১৮ জুন ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি $৮৭.৫০ ছুঁয়েছে, যা গত সপ্তাহের তুলনায় ৩% বেশি। বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, তেলের দাম প্রতি ডলার বাড়লে দেশটির বার্ষিক অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৫০-৭০ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৫% ডিজেলের ওপর নির্ভরতা এই সংকটকে আরও তীব্র করছে। ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানলে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA)।

২. রপ্তানি পথ অবরোধ:
লোহিত সাগরে হুথি হামলার কারণে ১২টি প্রধান শিপিং কোম্পানি (মার্স্ক, MSC সহ) তাদের রুট পরিবর্তন করেছে। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে সময় বাড়ছে ১৪-১৮ দিন এবং পরিবহন খরচ বেড়েছে ৩০-৬০%। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম থেকে নেদারল্যান্ডসের রটার্ডাম বন্দরে পণ্য পাঠাতে এখন প্রায় ২২,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে, যা পূর্বের চেয়ে ১০,০০০ কিলোমিটার বেশি। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BGMEA) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.২% ছিল, যা ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ১৫% ছাড়িয়েছিল।

৩. মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন:
জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি সরাসরি ভোক্তা মূল্যসূচকে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯.৮৯%। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, সংঘাত আরও বাড়লে এই হার ১২% ছাড়াতে পারে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংক বিভাগীয় সূত্রে জানা গেছে, ডলারের অনানুষ্ঠানিক বাজার ইতিমধ্যেই ১১৮ টাকা ছাড়িয়েছে, যা সংকট বাড়লে ১২৫-১৩০ টাকায় পৌঁছাতে পারে।

৪. রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের চাপ:
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাকরি হুমকির মুখে ফেলেছে। এপ্রিলে রেমিট্যান্স ২.০২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সংঘাত তীব্র হলে এই প্রবাহ মাসিক ১.৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিমধ্যেই ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ১০ মাসের আমদানি সক্ষমতার সমতুল্য। জ্বালানি আমদানি বিল বাড়লে রিজার্ভ আরও নেমে ২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

 জরুরি পদক্ষেপের অপরিহার্যতা
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অবিলম্বে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে:

জ্বালানি নিরাপত্তায় বৈচিত্র্য:
ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি তেল ক্রয় চুক্তি করা জরুরি। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে হাইড্রোপাওয়ার আমদানি চুক্তি ত্বরান্বিত করে বিদ্যুৎ খাতে ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। জ্বালানি রিজার্ভ ৯০ দিনে উন্নীত করার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

রপ্তানি বিকল্প পথ:
ভারতের সঙ্গে স্থলপথ বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে আগরতলা হয়ে মুম্বাই বন্দরে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে সময় ১০-১২ দিন এবং খরচ ২৫% কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো আসিয়ান বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

মুদ্রা স্থিতিশীলতা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে বাজারে হস্তক্ষেপ করা। এ মাসেই ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিক্রির পরিকল্পনা করা যেতে পারে। কৌশলগত পণ্য (গম, ভোজ্যতেল) এর মজুদ বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

কূটনৈতিক তৎপরতা:
সংঘাত নিরসনে বাংলাদেশকে OIC ও জাতিসংঘে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল নিরাপদ রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালো আহ্বান জানানো দরকার।

অদৃশ্য যুদ্ধের বাস্তব ক্ষতি
ইরান-ইসরাইল সংঘাত বাংলাদেশের জন্য শুধু ভূ-রাজনৈতিক সংকট নয়; এটি প্রতিদিনের জীবনে ডিজেলের দাম, কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং রেমিট্যান্স হ্রাসের মাধ্যমে সরাসরি আঘাত হানছে। টিবিএস নিউজের ১৮ জুনের বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—এই সংকট ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও বাংলাদেশের জন্য বেশি বিপজ্জনক, কারণ এখানে যুক্ত হয়েছে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি। সরকার যদি এখনই জ্বালানি নিরাপত্তা, রপ্তানি বিকল্প পথ এবং রিজার্ভ শক্তিশালীকরণে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশকে গভীর মন্দার মুখোমুখি হতে হবে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রচেষ্টার পাশাপাশি নিজস্ব অর্থনৈতিক সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এই সংঘাতে বাংলাদেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও তার অর্থনীতি যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

নোভা

×