ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রভাবনা

মোঃ মিজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৯ জুন ২০২৫

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রভাবনা

ছবি: সংগৃহীত

৫ আগস্ট ২০২৪! গণজাগরণের এক মহাকাব্যিক দিন। এদিন ছাত্র-জনতার গর্জনে কেঁপে উঠে স্বৈরশাসনের মসনদ, ভেঙে পড়ে দীর্ঘ দুই দশকের প্রতাপশালী শাসনব্যবস্থা। ছাত্র-জনতার উত্তাল তরঙ্গমালা পতন ঘটায় শেখ হাসিনার ২১ বছরের রাজত্ব। একটানা ১৫ বছরের অধিককাল দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতাচর্চার পর শেখ হাসিনা এইদিন চোখের পলকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এক বিস্ফোরিত প্রজন্মের স্বপ্ন, ক্ষোভ ও সংগ্রামের মহাকাব্যিক স্ফুরণে রচিত হয় এক নতুন ভোরের ইতিহাস। সূচনা করে নতুন বাংলাদেশের নির্মাণযাত্রা—যেখানে বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে রচিত হয় মানুষের স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়।

দীর্ঘদিনের চলমান দুর্নীতি, দুঃশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, টেন্ডারবাজি, বিদেশে অর্থ পাচার, মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ, ক্ষমতাসীনদের ঔদ্ধত্য আচরণ এবং সর্বোপরি মানুষের নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এসব বিষয়ে বৈষম্য লাঘব করাই ছিল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থান প্রথমত শুরু হয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে। সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ কোটার নামে রাষ্ট্রীয় চাকরিতে বৈষম্যমূলক বণ্টন বহাল করা হয়। ২০১৮ সালে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, ২০২৪ সালে এসে ফের জ্বলে ওঠে একটি রায়কে কেন্দ্র করে।

হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এর ফলে কোটা বহালের আশঙ্কায় আবারও উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের ক্যাম্পাসগুলো। আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১ জুলাই, ২০২৪। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়। ১৪ জুলাই, শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে মন্তব্য করলে, আন্দোলন আরও তীব্র রূপ ধারণ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ আন্দোলন সারাদেশব্যাপী গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

পরবর্তীতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা, পুলিশের গুলি, দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, আগ্রাসন—সবকিছুর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। বরং গণজাগরণে রূপ নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এতে যুক্ত হন। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, দিনাজপুর, পাবনা, রংপুর, চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের আগুন। সাধারণ মানুষ, দিনমজুর, কৃষক, শিক্ষক, এমনকি চাকরিজীবীরাও এই আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। ছাত্র-জনতার ঐক্য রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে নতুন পথ ধরতে।

আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে, রাস্তায় ট্যাংক নামিয়ে, শত শত প্রাণ ঝরিয়ে সরকার ভেবেছিল—ভয় দেখিয়ে সব দমন করা যাবে। অথচ তারাই তো একদিন রাজপথের আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছিল! কতটা আত্মবিস্মৃত হলে এমন ভুল করা যায়?

এর আগে ১৯৬৯ ও ১৯৯০—এই দুটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি বাঙালির ইতিহাসে গেঁথে আছে, যেখানে স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল জনতার বলিষ্ঠ প্রতিরোধে। এবারও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। কিন্তু শাসকেরা এবারও অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবারও কিছু জরুরি সত্য আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, যেমনঃ জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায় না মৃত্যু—জেল—জুলুমের ভয় দেখিয়ে; জনগণের সাথে অন্যায় আচরণ করলে তারা সময় ও সুযোগ মতো ফেটে পড়বেই; মৌলিক প্রয়োজন না মিটিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পদ লুটেপুটে নিলে জনগণ ছাড় দেয় না; জনগণের ওপর নির্যাতন বেড়ে গেলে তারা মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। একবার মরার জন্য প্রস্তুত হলে তাদের আর ঘরে ফেরানো যায় না।

বহু দশকের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ, বৈষম্য, দলতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ—সব কিছুর বিরুদ্ধে এই গণঅভ্যুত্থান একটি র‍্যাডিকাল প্রশ্ন এনে দিয়েছে—আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই? বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার নিপীড়ন, বৈষম্য ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের অবশ্যই একটি নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। যেখানে থাকবে নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ, এবং সকলের অংশগ্রহণে গড়ে উঠবে প্রকৃত গণতন্ত্র। রাষ্ট্র হবে জনগণের মালিকানায়, আর জনগণ থাকবে রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণে।

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াসেই নতুন রাষ্ট্রভাবনার রূপরেখা উঠে আসে, যা তিনটি মৌলিক স্তম্ভে নির্মিত হতে পারে:

১. নাগরিক-অভিমুখী মানবিক রাষ্ট্র: এখনকার রাষ্ট্র কাঠামোতে 'রাষ্ট্র' প্রায়শই একটি ক্ষমতা-প্রয়োগকারী যন্ত্রে রূপ নিয়েছে, নাগরিকের সেবকের পরিবর্তে তার শাসক হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রে এই চর্চার অবসান ঘটাতে হবে। একটি মানবিক রাষ্ট্রের মৌলিক শর্ত হলো—নাগরিকের জীবন, মর্যাদা ও মতপ্রকাশের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পুলিশের বুট নয়, চাই সহমর্মিতার ভাষা। প্রশাসনিক বলপ্রয়োগ নয়, চাই জবাবদিহিমূলক সেবাপ্রদান।

২. দলনিরপেক্ষ, বিকেন্দ্রীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা: দলতন্ত্র যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরুদণ্ড হয়ে পড়ে, তবে গণতন্ত্র রুগ্ন হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রে প্রয়োজন দলনিরপেক্ষ শাসন কাঠামো, যেখানে রাজনৈতিক দল থাকবে, তবে রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয় নয়—জনতার হবে। একইসাথে প্রয়োজন বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন—যেখানে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার সক্রিয় থাকবে। কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার স্থানীয় সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

৩. সাম্য, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ননীতি: যে কোটা সংস্কার প্রশ্ন থেকে এই আন্দোলনের সূচনা, তা ছিল মূলত একটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। সেই লড়াইকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই বিস্তৃত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সম্পদ বণ্টনে অবস্থানগত অসমতা দূর করে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্র কখনোই একটি টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়তে পারবে না।

এই নতুন রাষ্ট্রভাবনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড়িয়ে আছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, ন্যায়ের শাসন ও মানবিক সহাবস্থানের উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে—সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে ছাত্রসমাজই সবচেয়ে সক্রিয়, সাহসী ও অগ্রণী। সময় বদলের এই অভিযাত্রায় তারুণ্যের শক্তিই বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, আগামীতেও দেবে।

মুমু ২

×