ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

’বোমা পড়ছে, জেনারেল মারা যাচ্ছেন—তবু ইরানি সমাজ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে না’

প্রকাশিত: ১২:৩২, ১৯ জুন ২০২৫

’বোমা পড়ছে, জেনারেল মারা যাচ্ছেন—তবু ইরানি সমাজ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে না’

ইসরায়েলের চলমান সামরিক হামলা ইতিমধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তপার সংঘাতে পরিণত হয়েছে। এটা শুধু ক্ষেপণাস্ত্র সাইলো বা পারমাণবিক স্থাপনার ওপর সীমিত আঘাত নয়; বরং এর মধ্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ের হত্যাকাণ্ড ও উন্নতমানের সাইবার হামলাও। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, ইরানের কয়েকজন শীর্ষ জেনারেল—মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, আইআরজিসি কমান্ডার হোসেইন সালামি এবং এর অ্যারোস্পেস ফোর্স প্রধান আমির আলি হাজিজাদেহ—হত্যা।
এই লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাগুলো ১৯৮০-৮৮ ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর ইরানি সামরিক নেতৃত্বের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।

তবে এই হামলা শুধু সামরিক কৌশল নয়—এর ভেতরে আছে বহু দশকের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন।
যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এটিকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের আগেই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তবে এর গভীরতর কৌশলগত উদ্দেশ্য দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে: ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা।
বহু বছর ধরেই ইসরায়েলি ও কিছু মার্কিন কৌশলবিদ—কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে—বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বন্ধ করতে হলে একমাত্র টেকসই সমাধান হলো শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন।
বর্তমান অভিযান সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে—শুধু সামরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ দিয়েও।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, এ হামলার লক্ষ্য ইরানের ভেতরে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়া। এটা পুরোনো ‘রেজিম চেঞ্জ’ কৌশলের মতোই: শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, ভুয়া তথ্য ছড়ানো এবং রাষ্ট্রীয় প্রতীকী স্থাপনাগুলোতে আঘাত।
তেহরানে ইসরায়েল-সমর্থিত সাইবার আক্রমণ ও নির্ভুল হামলায় সরকারি ভবন ও মন্ত্রণালয়গুলোতে হামলা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে, এমনকি কিছু সময়ের জন্য জাতীয় টিভি সম্প্রচার ব্যাহত হয়েছে—যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অন্যতম যোগাযোগব্যবস্থা।

ইসরায়েলি রাজনৈতিক বক্তব্যও এই কৌশলের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
আন্তরিক ব্রিফিং ও বাছাই করা মিডিয়া সাক্ষাৎকারে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এত গভীরে (জাগরোস ও আলবর্‌জ পাহাড়ের নিচে প্রায় ৫০০ মিটার) অবস্থান করছে যে, তা ধ্বংস করতে হলে মার্কিন অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
এই জন্য প্রয়োজন হবে GBU-57 “ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর” বোমা—যা শুধু মার্কিন B-2 বা B-52 বোমারু বিমান দিয়েই নিক্ষেপযোগ্য।
এই সামর্থ্য না থাকায় ইসরায়েলি নেতৃত্ব বুঝে নিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম থামাতে হলে সরকার পতন ছাড়া উপায় নেই।

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের যৌথ সামরিক ও রাজনৈতিক প্রচারাভিযান নতুন মাত্রা পায়।
হামলার পর ইরানি জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচারণা জোরদার করা হয়, যেখানে আইআরজিসিকে জাতীয় রক্ষাকর্তা নয়, বরং জনগণের প্রধান নির্যাতনকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
এই প্রচার বলছে: “এটা ইরানের যুদ্ধ নয়, এটা শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধ।”
প্রবাসী বিরোধী ব্যক্তিরাও এই বক্তব্যে সুর মিলিয়েছেন—শেষ শাহর পুত্র রেজা পাহলভি ও প্রাক্তন ফুটবলার আলি কারিমি—যারা হামলার পক্ষে ও সরকার পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছেন।

তবে এই কৌশল হয়তো উল্টো ফল দিয়েছে।
যা জাতীয় বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তা উল্টো রাজনৈতিক বিভাজন ভুলিয়ে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে জোরদার করেছে।
অনেকে, যারা দীর্ঘদিন ধরে শাসনব্যবস্থার সমালোচক ছিলেন, এখন এটা বিদেশি আগ্রাসন হিসেবে দেখছেন এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
১৯৫৩ সালের সিআইএ-পৃষ্ঠপোষক অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ পর্যন্ত বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের স্মৃতি আবারো মানুষকে একত্রিত করেছে।

২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর যে “নারী, জীবন, স্বাধীনতা” আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সেই আন্দোলনের অনেক কর্মীও এখন বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে যেতে অনিচ্ছুক।
বোমায় বিধ্বস্ত ভবন ও নিহত ইরানি সেনাদের ছবি ছড়িয়ে পড়ায়, বিদ্রোহের বদলে সহমর্মিতা ও সংহতির আবেগ প্রবল হয়ে উঠেছে।
অনেকের কাছে এখন আলোচনার বিষয় হলো ‘রাজনৈতিক সংস্কার’ নয়, বরং ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা’।

বিশেষভাবে চোখে পড়ে যে, সরকারের বিরোধিতাকারী অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি এবার সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন।
ফুটবল কিংবদন্তি আলি দায়ি বলেছেন, “আমি মরতে রাজি, কিন্তু দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।”
একসময়কার বিচারক ও রাজনৈতিক বন্দি মোহসেন বোরহানি লিখেছেন, “যারা মাতৃভূমিকে রক্ষা করছেন, আমি তাঁদের হাত চুমু খাই”—তিনি এই কথায় আইআরজিসি ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীকে সম্মান জানিয়েছেন।

সব মিলিয়ে, যা শুরু হয়েছিল পরিকল্পিত সামরিক হামলা হিসেবে, তা এখন ঠিক উল্টো পথে এগোচ্ছে।
ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল ইরানি সরকারকে দুর্বল করা—কিন্তু তারা উল্টোভাবে জাতীয় ঐক্য জোরদার করে সরকারের অবস্থান মজবুত করছে।
বাইরের দিক থেকে বিপ্লব ঘটানোর যে চেষ্টা, তা ব্যর্থই নয়—বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।

যদি ইসরায়েলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে থাকে সরকার পতনের মাধ্যমে ইরানকে রূপান্তরিত করা, তবে তারা হয়তো ইরানি সমাজ ও ইতিহাসের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেছে।
বোমা পড়ছে, জেনারেল মারা যাচ্ছেন—তবু ইরানি সমাজ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে না।
বরং, মনে হচ্ছে, নিজেদের জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

 

লেখক: মোহাম্মদ ইসলামি

সূত্র - https://www.aljazeera.com/opinions/2025/6/18/israel-tried-to-break-iran-but-it-may-have-actually-helped-unite-it

 

 

সানজানা

×