ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

শিশুশ্রম: উন্নয়নের পথে এক গভীর ক্ষত

মো. কওনান মুরসালিন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৫:১৭, ১৯ জুন ২০২৫

শিশুশ্রম: উন্নয়নের পথে এক গভীর ক্ষত

ছবিঃ সংগৃহীত

ছোট্ট রাসেল, গ্রামের সবুজ প্রান্তরে বেড়ে ওঠা ৮ বছর বয়সী এক চঞ্চল ছেলে। চোখে তার অফুরন্ত স্বপ্ন, আর মনে স্কুলে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। ভোরের নরম আলোয় যখন তার বন্ধুরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে স্কুলে যেত, রাসেল তখন ব্যস্ত শহরের এক মোটর গ্যারেজে ভারী যন্ত্রপাতির নোংরা আর তেলকালি মাখানো জগতে। ছোট ছোট হাত দিয়ে কখনো সে গাড়ির চাকা টায়ার ওঠায় নামায়, কখনো ইঞ্জিন পরিষ্কার করে। কখনো তাকে শুনতে হয় কাস্টমারের কটু কথা, কখনো কাজের ভুলে মহাজনের অকথ্য গালিগালাজ ।

তার কচি হাতের খসখসে চামড়া আর ক্ষতচিহ্নগুলো সাক্ষ্য দেয় নির্মম বাস্তবতায় তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের। দিন শেষে যখন সে ক্লান্ত শরীরে গ্যারেজের এক কোণে ঘুমিয়ে পড়ে,  চোখে তখন তার ভাসে হারিয়ে ফেলা বইয়ের পাতা আর সেই সবুজ খেলার মাঠের স্বপ্ন। রাসেল একা নয়, তার মতো হাজারো রাসেল প্রতিদিন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন নীরব যন্ত্রণার শিকার।

গত ১২ জুন ২০২৫, ছিলো বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি—এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বালি। এই দিনে আমরা রাসেলের মতো অসংখ্য শিশুর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং তাদের অধিকারের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য গুলো স্মরণ করি আর ডে অবজারভেশন শেষে আবার ভুলেও যাই।

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে দ্রুত এগিয়ে গেলেও, উদ্বেগজনকভাবে শিশুশ্রম আমাদের সমাজের এক গভীর ক্ষত। গত কোভিড-১৯ মহামারীতে অনেক পরিবার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এবং ইউনিসেফ-এর ২০১৭ সালের 'জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ' অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৭ লক্ষ শিশুশ্রমিক রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এরা প্রধানত কৃষি, উৎপাদন শিল্প, পরিবহন, গৃহস্থালি কাজ, জাহাজ ভাঙা শিল্প এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে। যারা শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিক মাধ্যমিক  শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে  দারিদ্র্যের এক দুষ্টচক্রে বন্দী করছে।

শিশুদের এহেন শ্রমে আসার শেকড়ে মূলত দারিদ্র্য, পিতামাতার অসচেতনতা, পারিবার ভাঙ্গন, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সস্তা শ্রমের চাহিদা জড়িত। দরিদ্র পরিবার দু'বেলা খাবারের সংস্থান করতে না পেরে, স্কুলগামী শিশুটিকেই উপার্জনের জন্য কাজে পাঠায়। আর এই সুযোগটা নেয় কিছু অসাধু নিয়োগকর্তা, যারা কম মজুরিতে শিশুদের দিয়ে পরিশ্রমের কাজ করিয়ে নেয়। 

এই জটিল সমস্যার সমাধানে সরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও  সংস্থাগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম নিরসনে বদ্ধপরিকর। তারা 'বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬' (সংশোধিত ২০১৮) এর মাধ্যমে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। 'জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০' এবং 'জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন কর্মপরিকল্পনা' এর মাধ্যমে সরকার শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বিভিন্ন এনজিও শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। তারা সচেতনতা তৈরি, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের পুনর্বাসন এবং সহায়তাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ শিশুশ্রম নিরসনে একটি সমন্বিত মডেল অনুসরণ করে। তারা শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশ, পারিবারিক অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, শিশু সুরক্ষা ও অ্যাডভোকেসি (যেমন: 'শিশু সুরক্ষা কমিটি' ও 'শিশু ফোরাম' গঠন), এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করে। সম্প্রতি তাদের Five Zero Plus Plan এর প্রচেষ্টায় অনেক গ্রাম শিশুশ্রমমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

শিশুশ্রমের মতো একটি সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সরকার ও এনজিওগুলোর প্রচেষ্টার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। এই লক্ষ্যে আমাদের সকলেরই বেশকিছু দায়িত্ব রয়েছে। যেমন: শিশুশ্রমের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও অন্যদেরও সচেতন করা; ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক কোনো কাজে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে নিয়োগ না দেওয়া; আশেপাশে শিশুশ্রম দেখতে পেলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯৮, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম অধিদপ্তর বা পুলিশ) অথবা নির্ভরযোগ্য এনজিওকে জানানো; নিজেদের সন্তান এবং পরিচিতদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করা।
 সর্বোপরি, শিশুশ্রমমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া  বা স্থানীয় পর্যায়ে জনমত গঠনের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধে সামাজিক বলয় সৃষ্টি করা।

রাসেলের মতো আর কোনো শিশুকে যেন তার শৈশব হারাতে না হয়। প্রতিটি শিশুর জন্য একটি সুরক্ষিত শৈশব, মানসম্মত শিক্ষা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা আমাদের সকলের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। আসুন, বিশ্ব শিশুশ্রম বন্ধ দিবসে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শপথ নিই, শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করব।

লেখকঃ
মো. কওনান মুরসালিন
টেকনিকাল স্পেশালিস্ট- কমিউনিকেশন এন্ড এডভোকেসী
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।

 

তথ্যসুত্র:
 বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এবং ইউনিসেফ (UNICEF), "জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৭" (National Child Labour Survey 2017)।

 - আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) - World Day Against Child Labour: https://www.ilo.org/global/topics/child-labour/lang--en/index.htm

- ইউনিসেফ বাংলাদেশ (UNICEF Bangladesh) - Child Protection: https://www.unicef.org/bangladesh/en/child-protection

  - ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ (World Vision Bangladesh) - Child Protection and Child Labour Initiatives: https://www.worldvision.org.bd/what-we-do/child-protection

- WVB: Ending Violence Against Children: Child Labour
https://www.wvi.org/publications/policy-briefing/bangladesh/ending-violence-against-children-child-labour

  - বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)
https://tinyurl.com/mwarahjk

   - জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০

আলীম

×