
ছবি:সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য যেন আবারও উথালপাতাল সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। গাজা ভূখণ্ডের রক্তাক্ত প্রান্তরে ইসরায়েলের ক্রমাগত বিমান হামলা, ফিলিস্তিনিদের নির্মম নিধন, আর সেই সঙ্গে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি বাগ্যুদ্ধ ও সামরিক তৎপরতা—সব মিলিয়ে বিশ্ব যেন এক নতুন সংকটের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সংঘাত কেবল রাজনৈতিক কিংবা কূটনৈতিক বিরোধের সীমায় আবদ্ধ নয়; এর গভীরে রয়েছে ধর্ম, পরিচয়, ইতিহাস এবং ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে যুগ প্রাচীন দ্বন্দ্ব। ঐতিহাসিক নানা ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে সংগঠিত হচ্ছে এই যুদ্ধ। ইসরায়েলের কাছে আছে এক ধরনের ব্যাখ্যা, অন্যদিকে ইরানের সাথেও আছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক ভিত্তি। খোরাসানের সাথে আছে এক ঐতিহাসিক সংযোগ, এই খোরাসান অঞ্চল কিন্তু ইরানের সাথেই।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন—"খোরাসান দিক থেকে একদল মানুষ কালো পতাকা নিয়ে আগমন করবে। তারা এমনভাবে এগিয়ে আসবে যে, কেউ তাদেরকে থামাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে (জেরুজালেম) পৌঁছাবে এবং সেখানে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে।" আরেকটি হাদিসে এসেছে—"তোমরা যখন খোরাসান দিক থেকে কালো পতাকা আসতে দেখবে, তখন বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাদের সঙ্গে যোগ দিও, কারণ তাদের মধ্যেই থাকবেন আল্লাহর খলিফা মাহদী।" তাই ইসরাইলের সাথে ইরানের যুদ্ধ অনেকেই ঐতিহাসিক কিছু ভিত্তি হিসেবেই দেখছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক ভাষণে স্পষ্টত ধর্মীয় ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন, যেখানে তিনি ফিলিস্তিনিদের 'আমালেক' কিংবা 'হামান' জাতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই চরিত্রগুলো ইহুদি ধর্মগ্রন্থে চিহ্নিত শত্রু, যাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করার কথা বলা আছে। এমন ধর্মতাত্ত্বিক রেফারেন্স যখন একজন রাষ্ট্রপ্রধান তার সামরিক অভিযানকে বৈধতা দিতে ব্যবহার করেন, তখন তা নিছক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকে না; বরং রূপ নেয় এক ভয়াবহ ধর্মীয় যুদ্ধের রূপে। একে অনেক বিশ্লেষক বলছেন 'আধুনিক ধর্মযুদ্ধ'—যেখানে বাইবেলের ব্যাখ্যার ছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে ড্রোন ও বোমার বাস্তব যুদ্ধ।
ইরান, মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া প্রভাব বলয়ের প্রধান শক্তি হিসেবে, এমন এক সময়ে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরও সরব হয়ে উঠেছে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন, “ইসরায়েলের অস্তিত্বই এক অবিচার”, এবং গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চালানো নির্যাতনকে “ধর্মীয় অন্যায়ের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই অবস্থানে ইরান শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি দিয়েই থেমে থাকেনি; বরং সিরিয়া ও লেবাননে নিজেদের প্রভাবাধীন বাহিনী এবং অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করছে। ইসরায়েলও পাল্টা হিসেবে সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটিতে একাধিক হামলা চালিয়েছে, ফলে উত্তেজনা কেবল ফিলিস্তিন নয়, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা লেভান্ট অঞ্চলে।
এই সংঘাতের আবহে নতুন করে আলোচনায় এসেছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য। তিনি সম্প্রতি বলেন, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা মানে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।” ট্রাম্পের এই বক্তব্য, বিশেষ করে তার নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য—যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান ইভানজেলিকাল ভোটারদের সমর্থন আদায়ে ইসরায়েলের প্রতি এক ধরনের অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন। ইতিহাস বলে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্সিতে থাকাকালীন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক সমতা ধ্বংস করেছিলেন। এবারও তার হুঁশিয়ারি যেন সেই আগুনে ঘি ঢালার শামিল।
অন্যদিকে, সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক কিংবা পাকিস্তানের মত বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এই সংকটে কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন গালফ রাষ্ট্রগুলো একদিকে যেমন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্যদিকে তেমনি ইরান বিরোধিতাকে প্রাধান্য দিয়ে ফিলিস্তিন প্রশ্নে পিছিয়ে আছে। তুরস্ক কিছুটা কূটনৈতিক উচ্চারণ করলেও তা কার্যকর ভূমিকায় রূপ নেয়নি। মিশর গাজার সীমান্তে মানবিক সাহায্য পাঠালেও, তাদের কড়াকড়ি ও রাজনৈতিক দ্বৈতনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। পাকিস্তান ঐতিহ্যগতভাবে ফিলিস্তিনপন্থী হলেও বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কেবল বিবৃতি দিয়েই দায়সারা করেছে। ফলস্বরূপ, ইরান এই শূন্যস্থানে প্রবেশ করতে চাইছে—তাদের একমাত্রিক উদ্দেশ্য নিছক সহানুভূতি নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশলগত চেষ্টা।
এই পুরো সংকটকে অনেকে শুধু রাজনৈতিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখলেও, বাস্তবতা হলো, এটি এক জটিল ধর্মীয় পরিচয়-সংকট, যেখানে ইতিহাস ও মিথ রূপ নিচ্ছে সামরিক পরিকল্পনায়। নেতানিয়াহু বা খামেনি—দুজনেই তাদের বক্তব্যে ধর্মকে অস্ত্র করেছেন। একদিকে ইসরায়েল বাইবেল থেকে ব্যাখ্যা দিচ্ছে হামলার যৌক্তিকতা, অন্যদিকে ইরান শিয়া ভাবাদর্শ থেকে তৈরি করছে 'মুক্তির যুদ্ধ'-এর বিবৃতি। এই ধর্মীয় ব্যাখ্যা যখন রাজনীতিকে ছাপিয়ে যায়, তখন মানবতা হারিয়ে যায় বিভক্তির কুয়াশায়।
ইসরাইল চায় ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করে পুড়ো ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, আল আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে কিং সুলেমানের থার্ড টেম্পল গঠন করতে। কিন্তু এই আল আকসা আমাদের মুসলিমদের জন্য হৃদয়ের স্পন্দন, প্রথম কিবলা এবং মহানবী (সঃ) কে এই মসজিদ থেকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটার জীবন দিয়ে হলেও মুসলমানদের যুদ্ধ করা উচিত। ফিলিস্তিনের শিশু, মা, বৃদ্ধ—যারা প্রতিদিন জানে না আগামীকাল তারা বাঁচবে কিনা, তাদের জন্য এই লড়াইয়ের ব্যাখ্যা কতটুকু প্রয়োজন? এই যুদ্ধ কার পবিত্রতার, আর কার পাঁজরে ছুরি—তা হয়ত বিশ্বরাজনীতি বুঝবে, কিন্তু শরণার্থী শিবিরের অর্ধউলঙ্গ শিশু জানে না ‘আমালেক’ কে, ‘শিয়া’ বা ‘সুন্নি’ কী। তাদের কাছে যুদ্ধ মানে ক্ষুধা, মৃত্যু ও দুর্ভাগ্য। আর আমাদের কাছে এই প্রশ্ন থেকে যায়—এই আধুনিক সভ্যতা কি শেষতক আবার ধর্মের নামে ধ্বংসের পথেই চলেছে?
মারিয়া