ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ঢাকার বায়ু দূষণ ও জনস্বাস্থ্য সংকট: পরিবেশগত অধিকার ও আইনি চ্যালেঞ্জ

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০২:৩২, ১৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ০২:৫৯, ১৯ জুন ২০২৫

ঢাকার বায়ু দূষণ ও জনস্বাস্থ্য সংকট: পরিবেশগত অধিকার ও আইনি চ্যালেঞ্জ

ঢাকার আকাশ আজ আর নীল নয়। প্রতিদিন সকালে জানালা খুলে যে ধূসর আকাশের দিকে তাকাই, তা আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যাওয়া বিষাক্ত কণার এক ভয়াবহ চিত্র। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার গড় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ছিল ৩১৮, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সংখ্যাটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক নীরব ইঙ্গিত।

সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজের (ক্যাপস) তথ্য অনুযায়ী, গত নয় বছরে ৩,১১৪ দিনের মধ্যে মাত্র ৩১ দিন ঢাকাবাসী পরিচ্ছন্ন বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছে। এর অর্থ হলো, আমাদের শিশুরা জন্মের পর থেকেই বিষাক্ত বাতাসে বেড়ে উঠছে। ২০২৪ সালে মাত্র দুই দিন বাতাসের গুণমান ভালো ছিল, অথচ ৩৫ দিন বাতাস ছিল মারাত্মক ক্ষতিকর পর্যায়ে। এই পরিস্থিতি আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে: পরিচ্ছন্ন বাতাসে শ্বাস নেওয়ার অধিকার কি আমাদের মৌলিক অধিকার নয়?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এখন মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানুষের গড় আয়ু প্রায় পাঁচ বছর কমিয়ে দিচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে দুই লাখেরও বেশি মানুষ বায়ু দূষণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছে। ঢাকার PM2.5 এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো আমাদের ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে প্রবেশ করে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং শ্বাসকষ্টের মতো মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও কারখানার নির্গমন ২৯ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১৫ শতাংশ এবং আন্তঃসীমান্ত দূষণ ১০ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। এই তথ্যগুলো স্পষ্ট করে যে, বায়ু দূষণ একটি বহুমুখী সমস্যা যার সমাধানের জন্য সমন্বিত আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এ বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন বিধান রয়েছে। আইনের ৬ ও ৬(ক) ধারায় পরিবেশের ক্ষতিকর বস্তু উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ৯ ধারায় নির্ধারিত সীমার অধিক দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২২ সালের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা ও দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

তবে আইনি কাঠামো থাকলেও তার বাস্তবায়নে রয়েছে মারাত্মক ঘাটতি। পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের কথা থাকলেও তা এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। আদালতে সরাসরি মামলা করার সুযোগ না থাকায় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তকারীর রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পরিবেশগত ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে।

সরকার সম্প্রতি বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে জাতীয় বায়ু মান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০২৪-২০৩০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে PM2.5 এর মাত্রা ১৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার এবং ঢাকা অঞ্চলে ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার কমানো। অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কথা বলেছে।

কিন্তু এই উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়। পরিবেশগত ন্যায়বিচারের ধারণা অনুযায়ী, সকল মানুষের জাতি, বর্ণ, জাতীয় পরিচয় নির্বিশেষে সমান পরিবেশগত অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যগত হুমকি থেকে সুরক্ষা এবং জীবিকার অধিকার। বায়ু দূষণ এই সকল অধিকারকে লঙ্ঘন করছে।

সুতরাং, বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের আইনি কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। প্রথমত, পরিবেশ আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে এবং আদালতে সরাসরি মামলা দায়েরের সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বায়ু দূষণের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবেশগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

শুধু আইন করলেই হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নও জরুরি। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং, দূষণকারী উৎসগুলো চিহ্নিতকরণ এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।

ঢাকার বায়ু দূষণ শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি আমাদের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন। পরিচ্ছন্ন বাতাসে শ্বাস নেওয়ার অধিকার আমাদের জীবনের অধিকারের অংশ। এই অধিকার রক্ষায় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ রেখে যেতে হলে আজই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা আগামীর ইতিহাসে আমরা সেই প্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত হব, যারা নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের অধিকার হারিয়ে ফেলেছিল।

 

রাজু

×