
ছবিঃ সংগৃহীত
ইসরায়েল যখন ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু করে, তখন তার আগেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছিল। ইরান দাবি করে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, তবে তেলআবিব একে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।
১৩ জুন সকালে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যাতে ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত হন। তেহরান দাবি করেছে, এ হামলায় বেসামরিক প্রাণহানিও ঘটেছে।
১৩ জুন সন্ধ্যায় ইরান পাল্টা জবাব দেয়। তারা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে, যার মধ্যে ছিল যুদ্ধবিমান ও ফাইটার জেট রিফুয়েলিংয়ের ঘাঁটি। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিখ্যাত ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দিয়ে তেলআবিবের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে, যেখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর অবস্থিত।
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার এই সংঘাত এখন ষষ্ঠ দিনে প্রবেশ করেছে এবং এর কোনো অবসান এখনও দেখা যাচ্ছে না। সোমবার আবারও ইসরায়েল তেহরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় এবং প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু reportedly বলেন, যুদ্ধ শেষ হবে কেবল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির মৃত্যু ঘটলে।
এই হামলাগুলো ২০২৩ সালের হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের পর পশ্চিম এশিয়ায় সর্বশেষ সামরিক উত্তেজনার সূচনা করল। এতে আশঙ্কা বাড়ছে যে, এক সময়ের ‘মিত্র’ দেশ দুটির মধ্যে এবার হয়তো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।
তাদের সম্পর্কের সাম্প্রতিক ইতিহাস যদিও বিদ্বেষপূর্ণ, এক সময় ইরান ও ইসরায়েল ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে “ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি” বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে, ইরান বহুবার ইসরায়েলকে দোষারোপ করেছে তাদের দেশে নাশকতা ও হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য।
যখন তারা ছিল ‘বন্ধু’
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে বেশিরভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ব্যতিক্রম ছিল শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান এবং তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ইরান তখন পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে ছিল। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির নেতৃত্বে ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
তখন ইসরায়েলও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করছিল। সে সময়ে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের ‘পারিফেরি ডকট্রিন’-এর আওতায় তারা আরববহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা করে, যেখানে ইরান, তুরস্ক ও ইথিওপিয়া ছিল মুখ্য।
এই দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অস্ত্র বেচাকেনা, এমনকি গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান করত। ইরান ইসরায়েলকে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করত এবং ইসরায়েল ইরানে অবকাঠামো নির্মাণেও সহায়তা করত।
### সম্পর্ক ভাঙার শুরু
সবকিছু ঠিকঠাক চললেও, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব সব কিছু পাল্টে দেয়। শাহ পতনের পর ইরান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয় আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে।
এরপর ইরান ইসরায়েলি পাসপোর্ট অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে, এবং ইরানিরা "অধিকৃত ফিলিস্তিনে" ভ্রমণ করতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেয়। তখন থেকেই ইসরায়েলকে বলা হয় ‘ইসলামের শত্রু’ এবং ‘ছোট শয়তান’।
শত্রুতা আরও তীব্র হয়
১৯৮০-৯০ দশকে ইরান শুরু করে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ চালালে ইরান হেজবোল্লাহকে গঠন ও সহায়তা করে। পরে ইয়েমেনে হুতি এবং গাজায় হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে।
১৯৮৩ সালে হেজবোল্লাহ আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি সামরিক সদর দপ্তর ধ্বংস করে দেয়।
২০০০ সালে আয়াতুল্লাহ খামেনি ইসরায়েলকে 'ক্যান্সারাস টিউমার' হিসেবে অভিহিত করেন এবং ২০০৫ সালে বলেন, "ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের, তাদের ভবিষ্যৎ তারাই নির্ধারণ করবে।"
২০২৩ সালে হামাসের হামলার পর ইসরায়েল হামাস ও হেজবোল্লাহকে লক্ষ্য করে বড় আকারের সামরিক অভিযান চালায়।
এরপর ইরানও ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। পাল্টা জবাবে ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে। এতে ইরান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইসরায়েলের আক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেন, “ইসরায়েল একটি নতুন রেড লাইন অতিক্রম করেছে” এবং পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা “কূটনীতিকে ব্যাহত করার চক্রান্ত”।
এভাবেই বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতার সম্পর্কের এক রক্তাক্ত অধ্যায় লেখা হয়ে চলেছে ইরান-ইসরায়েল ইতিহাসে।
মুমু