
ছবি: জনকণ্ঠ
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চালিকাশক্তি হলেন শিক্ষকগণ। তাঁদের মূল দায়িত্ব পাঠদান ও গবেষণা হলেও আমাদের দেশে তাঁদের উপর অর্পিত হয় প্রশাসনিক দায়িত্বও—যেমন প্রক্টর, প্রভোস্ট, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা, পরিবহন প্রশাসক, গ্রন্থাগার পরিচালক, আইসিটি সেল ইত্যাদি অসংখ্য পদে তাঁদের কর্মব্যস্ত দেখা যায়। দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের দিয়ে প্রশাসনিক কাজ করানো হয়। তবে এসবে শিক্ষকদের আগ্রহও নেহাত কম নয়। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনার জন্ম হয়েছে ইতিপূর্বে। একপক্ষ মনে করেন, একজন শিক্ষককে শুধুমাত্র ক্লাস, গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে কঠোর মনোযোগ দিতে হবে। অন্যপক্ষ মনে করেন, একজন শিক্ষকই শিক্ষার্থীর সবচেয়ে কাছের মানুষ, তাই তিনি প্রশাসক হওয়াই যৌক্তিক। এই দ্বৈততার মধ্যে প্রশ্ন উঠে—একজন শিক্ষক কি একজন সফল প্রশাসক হতে পারেন? এবং এই দ্বৈত দায়িত্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় কী রূপ প্রভাব ফেলে?
প্রশাসনিক দায়িত্ব শিক্ষকদের উপযোগী?
প্রথমত, শিক্ষকরা প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করলে যে সুবিধাগুলো হয় তা স্পষ্ট। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তাঁদের মানসিকতা, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলো অনেক বেশি কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন। এর ফলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলোও হয় অধিকতর শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট, সংবেদনশীল ও বাস্তবধর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিন মেইনটেইন, আবাসন ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ছাত্র রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একজন শিক্ষক প্রশাসক হয়ে দ্রুত ও মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতেও সহায়ক। এসব নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ, তাঁরাই জানেন কীভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করা যায়।
বিতর্কের উৎস
একজন শিক্ষক যদি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ক্লাস নেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজ করেন তাহলে গবেষণা, পাঠ প্রস্তুতি এবং শিক্ষার্থীদের সাথে ইন্টারঅ্যাকশন কোথায় থাকবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং ও গ্লোবাল একাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডে গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের চাপে পড়াশোনার সময়ও পান না, গবেষণা তো দূরের কথা। অনেকে ক্লাসে ঠিকভাবে উপস্থিত হতে পারেন না। এতে পাঠদানের মান ক্ষুণ্ন হয়। আরেকটি সমস্যা হলো—কখনও এই দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ অতি ক্ষমতাবান হয়ে পড়েন। তাঁরা ছাত্রদের সমস্যা বুঝে ওঠার বদলে ‘প্রশাসনের প্রতিনিধি’ হয়ে যান। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেকসময় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষক হেনস্তা ও কটূক্তি, কার্যালয়ে তালা, অবাঞ্ছিত ঘোষণা কিংবা পদত্যাগ দাবি তার মধ্যে অন্যতম। ছাত্র-শিক্ষক মুখোমুখি অবস্থান এখন দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে।
এমতাবস্থায় করণীয়?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালাতে তো কেউ না কেউ লাগবেই। তাহলে শিক্ষক ছাড়া অন্য কে? অনেকে মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাদার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হোক, তাঁরাই শুধু প্রশাসনিক দেখভাল করবেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা শিক্ষার কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারবেন। উন্নত বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থাই বিদ্যমান বলে শুনেছি। তবে বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশে এখনো সে ধরনের কাঠামো গড়ে ওঠেনি। তাই শিক্ষককেই এই দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে। এহেন দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজন সুষম ভারসাম্য আনয়ন। শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্বের চাপে একাডেমিক কাজের ক্ষতি করবেন না—এতে সচেষ্ট থাকবেন। এজন্য প্রয়োজন স্পষ্ট নীতিমালা, নির্দিষ্ট সময়সীমায় দায়িত্ব প্রদান এবং প্রশাসনিক কাজে পর্যাপ্ত সহকারী নিশ্চিত করা। পাঠদান ও প্রশাসনের এই দ্বন্দ্বকে সমন্বয় করে নিতে হবে।
মুমু ২