
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের দীর্ঘদিনের মিত্র হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতি এবং ইরাকি শিয়া মিলিশিয়ারা আজ আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলার মুখে তেহরান যখন প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন এই ‘প্রক্সি ফোর্সগুলো’ প্রায় অদৃশ্য।
চলতি সংঘাতের সপ্তম দিনে প্রশ্ন উঠছে—ইরান কি কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো একা যুদ্ধ করছে?
চার দশকের ‘প্রতিরোধ জোট’ এখন কোথায়?
ইরান ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একটি 'প্রতিরোধ অক্ষ' গড়ে তুলেছে। উদ্দেশ্য—মার্কিন ও ইসরায়েলি প্রভাব ঠেকানো এবং নিজেকে সরাসরি সংঘাত থেকে নিরাপদ রাখা। সেই লক্ষ্যেই হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতি ও ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের সংগঠন, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করে এসেছে তেহরান।
কিন্তু আজ, তেহরানের মিত্ররা হয় বিধ্বস্ত, বিভক্ত, নয়তো আত্মরক্ষায় ব্যস্ত।
হিজবুল্লাহ: শক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে?
লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে পরিচিত। তবে ইসরায়েলি হামলার জবাবে তারা এখনও কোনো বড় পাল্টা আক্রমণ চালায়নি। ২০২৩ সাল থেকে একের পর এক ইসরায়েলি অভিযানে সংগঠনের মনোবল, নেতৃত্ব এবং অস্ত্রভান্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০২৪ সালে একটি ড্রোন হামলায় বহুদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন, যা হিজবুল্লাহর জন্য ছিল বড় ধাক্কা। নতুন নেতা নাইম কাসেম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ইরানি প্রভাবাধীন নেতার মতো নয়, বরং একজন লেবানিজ কূটনীতিকের মতো কথা বলেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, তার অফিসে কোথাও ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ছবি কিংবা কোনো ইরানি প্রতীক চোখে পড়েনি।
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর, ইরান-হিজবুল্লাহর অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহে যে রুট ছিল, সেটিও ব্যাহত হয়েছে।
হামাস: ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে?
গাজার হামাস এখন আগের সেই শক্তিশালী অবস্থানে নেই। প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত, আর খালেদ মেশাল কাতারে অবস্থান করছেন। মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব কার হাতে—তা এখনো পরিষ্কার নয়।
রকেট কারখানা, সুড়ঙ্গ পথ, কমান্ড সেন্টারসহ হামাসের সামরিক কাঠামো কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা থেকেই এই অঞ্চল অগ্নিগর্ভ হয়। কিন্তু তেহরান বরাবরই কেবল রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে—সরাসরি সামরিক সহায়তা সীমিতই ছিল।
ইরাক: অস্ত্র ছেড়ে ব্যবসায়
ইরাকে ইরানপন্থী শিয়া মিলিশিয়ারা এক সময় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হামলা ও ইরানি স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ছিল। কিন্তু এখন তারা অনেকটাই চুপ। কেবল কাতায়েব হিজবুল্লাহ একবার বিবৃতি দিয়েছে—তাও অস্পষ্ট হুমকি, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আক্রমণ করে তবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানি নিজে তেহরান ও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ। তিনি মিলিশিয়া নেতাদের সংঘাত থেকে দূরে থাকতে অনুরোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
হুতি বিদ্রোহীরা: পেছনে সরে গেছে?
ইয়েমেনের হুতিরা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আলোচনায় ছিল। তবে মার্চ ও এপ্রিল মাসে মার্কিন ড্রোন হামলায় তাদের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ধ্বংস হলে, তারা অনেকটা সংযত হয়ে পড়ে।
তাদের অবস্থান এখনও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হলেও সামরিক তৎপরতা কমে এসেছে। হুতি নেতারা তেহরানের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখলেও অনেকটাই স্বাধীন কৌশল নিচ্ছে।
‘চারদেশের বিশৃঙ্খলা অক্ষ’
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ইরানের মিত্ররা তেমন সক্রিয় নয়। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া—এই তিন দেশকে নিয়ে ইরানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি ‘চতুষ্টয়’ জোট, যাকে অনেকে বলেন ‘Axis of Upheaval’ বা ‘CRINK’ (China, Russia, Iran, North Korea)।
রাশিয়া: ইসরায়েলের হামলাকে ‘অপ্রত্যাহারযোগ্য আগ্রাসন’ বললেও সরাসরি জড়াতে চায় না।
চীন: ইরানের তেল কেনে সবচেয়ে বেশি, বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করেছে। তবে সামরিক দিক থেকে নয়, কূটনৈতিক সমাধানেই আগ্রহী।
উত্তর কোরিয়া: ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক কর্মসূচিতে অতীতে সাহায্য করলেও এবার নীরব।
ভারত: দ্বিপাক্ষিক কৌশলে
ভারত একদিকে যেমন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে তেহরানের সঙ্গেও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০২৪ সালে ভারত ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন ও পরিচালনায় ১০ বছরের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতায় ইরান দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধের স্থপতি ছিল—প্রক্সি বাহিনী দিয়ে নিজেদের লড়াই লড়ত। কিন্তু এখন, ইরান একা হয়ে পড়ছে। তার সাবেক মিত্ররা হয় ক্ষতবিক্ষত, নয়তো নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। তেহরানের সামনে প্রশ্ন—এই যুদ্ধে সে কতটা এগোবে, যখন চারপাশে আর কেউ সাড়া দিচ্ছে না?
সূত্র: এনডিটিভি।
রাকিব