
আলোক ঝলমলে এক প্রাণ আজ নিঃশব্দে নিভে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে আলো ছড়ানো সেই পোকাগুলোর এখন আর দেখা মেলে না।
এক সময় গ্রামের সন্ধ্যা মানেই ছিল ঝোপ-জঙ্গল, ধানক্ষেত আর খেলার মাঠে ঝিকমিক আলো জ্বালানো জোনাকিপোকার আনাগোনা। শিশুরা দল বেঁধে জোনাকি ধরত, ছোট কাচের শিশিতে রেখে দেখত তাদের আলো জ্বলা নিভে যাওয়া। কিন্তু এখন? আধুনিক সভ্যতার কোলাহলে, কৃত্রিম আলোর শহরে, জোনাকির সেই আলোর ঝিলিক আজ প্রায় অতীত।
জোনাকিপোকা কারা?
জোনাকিপোকা (Firefly বা Lampyridae) একধরনের বায়োলুমিনেসেন্ট পতঙ্গ, যারা নিজেদের দেহ থেকে আলো ছড়াতে পারে। এদের আলো মূলত প্রজনন মৌসুমে সঙ্গীকে আকর্ষণের জন্য। এই আলো পুরোপুরি প্রাকৃতিক এবং বিদ্যুৎ বা উত্তাপ ছাড়াই তৈরি হয়—একটি দুর্লভ ও জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকিপোকা?
১. কৃত্রিম আলোর দখলে প্রকৃতি
বর্তমানে শহর তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও রাত নেই বললেই চলে। দোকানপাট, মোবাইল টাওয়ার, রাস্তার আলো—সব মিলিয়ে রাতের প্রকৃত অন্ধকার হারিয়ে যাচ্ছে। জোনাকিরা অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে সঙ্গী খুঁজে পায়। কিন্তু কৃত্রিম আলোর মাঝে তারা বিভ্রান্ত হয়, প্রজননে বিঘ্ন ঘটে।
২. অতিরিক্ত কীটনাশক
ধান বা সবজি চাষে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকা নয়, জোনাকিসহ উপকারী অনেক পোকামাকড় ধ্বংস করছে।
৩. আবাসস্থলের বিলুপ্তি
ঝোপঝাড়, জলাভূমি, পাতাঝরা এলাকা, পচা গাছপালা—এই জায়গাগুলোতেই জোনাকিরা ডিম পাড়ে, বাচ্চা বড় করে। কিন্তু বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, বিল্ডিং ও ইটভাটার কারণে এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন
অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টির তারতম্যে জোনাকিপোকার জীবনচক্র বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের ডিম ও লার্ভা পর্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জোনাকিপোকার গুরুত্ব কী?
কৃষির বন্ধু: লার্ভা অবস্থায় এরা মাটিতে থাকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে।
পরিবেশের সূচক: যেসব এলাকায় জোনাকি থাকে, সেখানে পরিবেশ এখনো তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার ও ভারসাম্যপূর্ণ।
গবেষণায় ব্যবহৃত: জোনাকির আলো উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে।
তাদের রক্ষা করতে করণীয়
১. বাসার আশপাশে অন্ধকারের সুযোগ রাখা।
২. কীটনাশক নয়, জৈব সার ব্যবহার।
৩. জোনাকির জন্য বন্ধুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা।
৪. শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
৫. স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদীদের উদ্যোগ নেওয়া।
জোনাকিপোকা হারিয়ে যাওয়ার অর্থ প্রকৃতির ভারসাম্যের একটি স্তম্ভ ভেঙে পড়া। একটুখানি সচেতনতা, প্রকৃতিকে ভালোবাসা, আর পরবর্তী প্রজন্মকে প্রকৃতির বন্ধু করে তোলাই পারে এই আলোকিত প্রাণগুলোকে ফিরিয়ে আনতে।
Jahan