
শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা মিলনায়তনে শনিবার অনুষ্ঠিত বিশ্ব সংগীত দিবসের একটি পরিবেশনা
সুরের স্রোতধারায় প্রফুল্ল হয় মন-প্রাণ । অশুভ ও অকল্যাণকে দূরে সরিয়ে হৃদয়ে জাগ্রত করে শুভবোধ। বিকশিত করে মননকে। নব নব পত্রপুষ্পে ভরিয়ে তোলে জীবনকে। কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায়। অন্তরের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে উস্কে দেয় মানবিকবোধকে। একই সঙ্গে অপার্থিব এক সুখানুভূতি ছড়িয়ে দেয় চৈতন্যে। তাই সংগীত ছাড়া সভ্যতা যেন বিমর্ষ কিংবা অর্থহীন। আর শনিবার ছিল জীবনের সঙ্গে সংগীতের নিবিড় সংযোগ স্থাপনের অনন্য এক দিন- বিশ্ব সংগীত দিবস।
সুরের আগুনে অসুরকে দমন করে কল্যাণময় পৃথিবীর প্রত্যাশ্যায় উৎসবমুখর আবহে উদ্যাপিত হয়েছে দিবসটি। কণ্ঠশিল্পী থেকে যন্ত্রশিল্পীদের মাঝে বয়ে গেছে প্রাণের উচ্ছ্বাস। তাদের অংশগ্রহণে বের হয়েছে বর্ণিল শোভাযাত্রা। বেজেছে অর্কেস্ট্রার মায়াবি সুর। ভিন্নতার আস্বাদে পরিবেশিত হয়েছে আদিবাসী সম্প্রদাযের গান। উপস্থাপিত হয়েছে জনপ্রিয় ব্যান্ড দলের শিল্পীদের পরিবেশনা। গান শুনিয়ে শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়েছেন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীরা।
সুরের আশ্রয়ে উচ্চারিত হয়েছে বাংলার কালজয়ী গীতিকবিদের কালোত্তীর্ণ গীতবাণী। এভাবেই শহর ঢাকায় সরবতা ছড়িয়েছে সংগীত দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। দিবসটি উদ্্যাপনে পৃথক পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সৃষ্টি বিশ্বময়। আষাঢ়ের সন্ধ্যায় বর্ণিল রূপ পায় সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমি আঙিনা। আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয় একগুচ্ছ বেলুন। রঙ্গিলা পোশাকসহ নানা অনুষঙ্গকে সঙ্গী করে নেচে-গেয়ে বের হয় শোভাযাত্রা। এরপর আয়োজনটি চলে যায় একাডেমির নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে।
এখানে অনুষ্ঠিত হয় বৈচিত্র্যের সন্ধানী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বের শুরুতেই শোনা যায় রকমারি বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে সৃষ্ট সুরেলা শব্দধ্বনি। একাডেমির যন্ত্রশিল্পীদের পরিবেশিত অর্কেস্ট্রার বাদনে ভালোলাগার অনুভবে প্লাবিত হয়েছে সুররসিকের অন্তরাত্মা। সুরের ঝংকার তোলা সে পরিবেশিনায় বেজেছে বেহালা, বাঁশিসহ রকমারি বাদ্যযন্ত্র। এরপর কোলাজ গানে শ্রোতার মন কেড়েছে একাডেমির কণ্ঠশিল্পীবৃন্দ। ভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতির আলিঙ্গনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের গান শুনিয়েছে চিম্বুক ও বম শিল্পীগোষ্ঠী। এরপর ছিল সমবেত সংগীত পরিবেশনা।
এতে অংশ নেন দেশের জনপ্রিয় তারকা শিল্পীবৃন্দ। কোলাজ গানের আশ্রয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসিয়েছে জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পীবৃন্দ। এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক মেহজাবীন রহমান। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন। সভাপতির বক্তব্যে ওয়ারেছ হোসেন বলেন, আমরা আজ দেখছি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্রের ঝনঝনানি, ক্ষমতার দম্ভ, ক্ষমতার দাপট। মানবতাকে ভুলে, মানবতাকে ভুলণ্ঠিত করে আজ শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে হত্যা করছেন।
আমি মনে করি যে দেশে যত বেশি সাংস্কৃতিক চর্চা হবে, বিশেষ করে সংগীতের চর্চা হবে সে দেশে যুদ্ধ থাকতে পারে না। এদিকে দিবসটি উদ্যাপনে ‘সুরের ছোঁয়া শান্তি ও সুস্থতা’ স্লোগানে বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন সৃষ্টি বিশ্বময়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজ। সংগীতকে সারা বিশ্বের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রত্যয়ে এবং বিশ্বব্যাপী সংগীতপ্রিয় মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে ঢাকাসহ দেশের প্রধান কয়েকটি শহরেও দিবসটি উদ্যাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনটি।
সেই পথরেখায় প্রথম পর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে যশোর, সিরাজগঞ্জ ও সিলেটে এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। প্রসঙ্গত, ফরাসী ভাষায় ফেট ডে লা মিউজিক আর বাংলায় বিশ্ব সংগীত দিবস। সেই প্রেক্ষাপটে বহু বছর ধরেই এইদিনে ঐতিহ্যবাহী মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করছে ফ্রান্স। ১৯৮২ সালে এসে এ ফেস্টিভ্যাল ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’তে রূপ নেয়। ১৯৮২ সালে ফরাসি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং সর্বপ্রথম বিশ্ব সংগীত দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। ১৯৮৫ সালের ২১ জুন প্রথম গোটা ইউরোপ এবং পরে সারা বিশ্ব এই সংগীত দিবস পালন করে। এরপর থেকে দিনটি বিশ্ব সংগীত দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়।