
ছবি: প্রতীকী
ইরানকে কেন সহ্য করতে পারে না পশ্চিমা বিশ্ব? কেন ইরানের দিকে তাকিয়ে থাকে এতোসব নিষেধাজ্ঞা, হামলা ও রাজনৈতিক অবরোধ? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ইরানের তথাকথিত ‘সাতটি গুরুতর অপরাধে’।
ইরান পশ্চিমা বিশ্বের চোখে যে এক ‘বিষফোড়া’ হয়ে উঠেছে, তার পেছনে রয়েছে ভূরাজনীতির অন্ধকার অলিগলি, কর্পোরেট স্বার্থ, আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও আত্মপরিচয়ের বিপ্লব।
১. আত্মপরিচয়ের বিপ্লব – ১৯৭৯
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব ছিল ইরানের জন্য এক টার্নিং পয়েন্ট। এটি ছিল শুধুমাত্র শাহ মোহাম্মদ রেজা পহলবীর পতন নয়, বরং একটি আত্মিক রূপান্তর—যেখানে ইরানীরা বুঝেছিল, তারা আর পশ্চিমা শক্তির পুতুল হয়ে থাকতে পারবে না।
তারা আইএমএফ, ন্যাটো, বিশ্বব্যাংকের কৌশল থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল, ‘আমরা নিজেদের পথ নিজেরা ঠিক করব।’ এই ঘোষণাই ছিল পশ্চিমের জন্য সরাসরি যুদ্ধঘোষণার শামিল।
২. অর্থনৈতিক বিদ্রোহ – স্বনির্ভর উৎপাদন ও ‘রেজিস্ট্যান্ট ইকোনমি’
ইরান এমন একটি অর্থনৈতিক মডেল গড়ে তুলেছে, যেখানে তারা নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করে, নিজেরাই জ্বালানি ও প্রযুক্তি তৈরি করে।
এই ‘ঘরভিত্তিক উৎপাদন’ মডেল আন্তর্জাতিক কর্পোরেট স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। কারণ এটি পশ্চিমা কোম্পানির জন্য বাজার সংকুচিত করে। ইরান বুঝতে পেরেছে—ডলার মানেই বিশ্বব্যবস্থার দাসত্ব। তাই তারা ঘোষণা করেছে, তেল বিক্রি করবে ইউরো, ইউয়ান এমনকি রিয়ালেও।
৩. অর্থনৈতিক সন্ত্রাস মোকাবিলা–নিষেধাজ্ঞা থেকেই শক্তি
পশ্চিম ইরানকে ধ্বংস করতে বারবার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে—ব্যাংক লেনদেন বন্ধ, বিদেশি বিনিয়োগে বাধা, তেল রপ্তানি আটকে দেওয়া ইত্যাদি।
কিন্তু ইরান পাল্টা জবাবে দাঁড় করিয়েছে ‘রেজিস্ট্যান্ট ইকোনমি’ তত্ত্ব—যেখানে নিষেধাজ্ঞাই পরিণত হয়েছে আত্মনির্ভরতার মূল শক্তিতে। আর এতে করে পশ্চিম বুঝতে শুরু করেছে, তাদের চাপের অস্ত্র আর কার্যকর নয়।
৪. প্রতিরক্ষা কাঠামো–বাইরের সাহায্য ছাড়াও শক্তিশালী
যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি সামরিক জোটের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে ইরান তৈরি করেছে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, সাইবার প্রযুক্তি—সবই নিজেদের তৈরি। এমনকি ইসরায়েল-সৌদি আরব পর্যন্ত তাদের ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছাতে সক্ষম।
পশ্চিম জানে, এই শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিয়ন্ত্রণহীন শক্তি মানেই শত্রু।
৫. আদর্শিক বিপ্লব–ধর্ম, প্রযুক্তি ও আত্মত্যাগ
ইরানের বিপ্লব ছিল ভোগবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে আদর্শিক প্রতিবাদ। পশ্চিম যেখানে বলছে, ‘জীবন উপভোগের জন্য, ধর্ম ঘরের কোণে”—ইরান বলছে, “জীবন সমাজের জন্য, ধর্ম জীবনের কেন্দ্র।’
সেখানকার স্কুলে শেখানো হয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মত্যাগ। রাস্তায় লেখা থাকে—‘আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করব না।’
এই মিশ্রণ পশ্চিমা লিবারালিজমের পরিপন্থী। এবং এটিই ইরানকে পরিণত করেছে এক দর্শনের দুর্গে।
৬. প্রভাব বলয়–মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধ শক্তি
ইরান শুধু নিজের দেশের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এক আদর্শিক প্রভাব বিস্তার করেছে। ফিলিস্তিনে হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইরাকে শিয়া মিলিশিয়া—সব জায়গায় ইরানের ছায়া।
ইসরায়েল জানে, শক্তিশালী ইরান মানেই ফিলিস্তিনে আরও সংগঠিত প্রতিরোধ। আর পশ্চিম জানে, ইরান ভেঙে না ফেললে বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠিত হতে থাকবে।
৭. অপরাধের শাস্তি–বিজ্ঞানী হত্যা থেকে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত
এই সাতটি ‘অপরাধের’ জন্যই ইরানের ওপর চলছে অবিরাম যুদ্ধ। বিজ্ঞানী ফাখরিজাদে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানী থেকে শুরু করে ড্রোন হামলা, সাইবার আক্রমণ, গুপ্তচরবৃত্তি—সবই এই শাস্তির অংশ।
তবুও তেহরান নত হয়নি। ২০২৫ সালের জুনে ইসরায়েলি হামলায় এক গবেষণা কেন্দ্র ধ্বংস হলেও, সাদা ল্যাবকোট পরা এক তরুণী ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আমরা হারিনি, কারণ আমরা বিক্রি হইনি।’
ইরান আজ শুধু একটি দেশ নয়—এক আদর্শ, এক মিশন। যেখানে প্রযুক্তি আর প্রার্থনা, বিজ্ঞান আর বিশ্বাস পাশাপাশি চলে। এই যুদ্ধ কেবল ভূখণ্ড রক্ষার নয়, একটি জীবনদর্শনের লড়াই—যা পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু তীব্র প্রতিরোধ।
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=M5HBm4fRuxc
রাকিব