
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউস দখল করে রেখেছেন, ইউরোপ তখন একটি এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, যা তারা বহুদিন ধরে এড়িয়ে এসেছে:
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক মিত্রতা আঁকড়ে ধরে থাকবে, নাকি সময় এসেছে নতুন কোনো পথ বেছে নেওয়ার—যেটি হয়তো পূর্বমুখী?
চলতি বছরের এপ্রিলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজকে আহ্বান জানান, যাতে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উদ্বুদ্ধ করেন ওয়াশিংটনের “একতরফা চাপের” বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়তে। এই চাপ শুধু বাণিজ্যক্ষেত্রেই নয়, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বৈশ্বিক কৌশলেও বিস্তৃত। ইউরোপের জন্য প্রশ্নটি এখন আর শুধু এটুকুতে সীমাবদ্ধ নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী মিত্র কিনা; বরং তা হলো—যুক্তরাষ্ট্র আদৌ এখনো সঠিক মিত্র কি না।
চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখন ইউরোপের জন্য কিছু স্পষ্ট সুবিধা এনে দিতে পারে—এমন আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে জুলাই মাসে অনুষ্ঠেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন-চীন সম্মেলনে। যদিও ইউরোপের চীন-নীতি এখনো সতর্ক, যা Temu ও Shein-এর মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে সস্তা পণ্যে সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপে প্রতিফলিত হয়, তবু কৌশলগতভাবে ইউরোপ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ঝুঁকে থাকে—বিশেষ করে আর্থিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে। এই ঝোঁক ইতিহাসনির্ভর হলেও, ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের সঙ্গে তা ক্রমেই বেমানান হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই একটি লক্ষ্য নিয়ে চলেছে: বিশ্বে একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে এই নেতৃত্ব এক ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে, মানবাধিকার, একাডেমিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়ের ওপর চলছে অব্যাহত আক্রমণ। গাজায় ইসরায়েলের গণবিধ্বংসী অভিযানে ট্রাম্পের নিঃশর্ত সমর্থন, ইরানের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের অনুমোদন, গণপ্রত্যাবাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডিং বন্ধের মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র সেই সব আদর্শকেই বিপন্ন করছে, যেগুলোর প্রচারে সে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছিল।
চীনের রয়েছে একটি মাত্র বিদেশি সামরিক ঘাঁটি—জিবুতিতে, সঙ্গে কয়েকটি ক্ষুদ্র সহায়ক স্থাপনা। আর যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৭৫০টির বেশি বৈশ্বিক সামরিক ঘাঁটি।
ট্রাম্প সম্প্রতি গাজাকে “মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা” বানানোর ভিডিও শেয়ার করেছে এবং সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসনের কথা বলেছে। বিপরীতে, চীন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বিরোধিতা করেছে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করেছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও চীন ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। ৩,০০০-এর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে, যেখানে শিক্ষাব্যয় বছরে মাত্র ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ ডলার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০,০০০ ডলারের খরচের তুলনায় অনেক কম। তৎসত্ত্বেও, যেমন তিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অনেক প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জন করছে গবেষণার ক্ষেত্রে। যদিও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় পরিচালিত, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাস্তবতায়, যেখানে ক্যাম্পাসে ছাত্রদের দমন, ভিসা সংকট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে, সেখানে এগুলো একটি গুরুতর বিকল্প হয়ে উঠছে।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ইউরোপ কেন এখনো এমন একটি জোটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যা তার মূল্যবোধ ও স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে?
বাস্তবতা হলো, ইউরোপ এখনো সত্যিকারের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্জন করেনি। এর নেই একটি অভিন্ন অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী, করব্যবস্থা বা শ্রমবাজার। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—এই মহাদেশ ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে বিভক্ত।
সার্বভৌমত্ব অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, মিত্র পরিবর্তনের যেকোনো আলোচনা—যত জরুরি হোক না কেন—থেকে যাবে মূলত তাত্ত্বিক পর্যায়ে।
এদিকে চীন প্রস্তুত রয়েছে সহযোগিতার নতুন যুগের জন্য। কিন্তু ইউরোপ, পুরনো আনুগত্য আর অভ্যন্তরীণ বিভাজনের জালে আবদ্ধ হয়ে, এখনো প্রস্তুত নয়।
সূত্র - https://www.aljazeera.com/opinions/2025/6/20/why-the-eu-should-choose-china-over-the-us
সানজানা