
দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে খুব আরাম বা মজা করে বেড়াচ্ছে কিছু লোক। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। খবরের কাগজের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। এক বছরে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্রাঁ। যা খুবই দুঃখজনক। যদিও বিশ্লেষকরা নানাবিধ কারণের কথা বলেছেন।
দেশের গরিব মানুষ ঠিকমতো খেতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু অসৎ লোক, ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদ জনগণের টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে। কিন্তু কোনো শাস্তি পায় না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে এতে অসৎ ব্যক্তি টাকা পাচার বা দুর্নীতি করতে আরও বেশি উৎসাহী হয়। পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন। যাতে কেউ ভবিষ্যতে বিদেশে টাকা পাচার করার সাহস না পায়।
সম্প্রতি অনেকের নামে বিদেশে টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু অতীতে বিচারের তেমন উদাহরণ দেখা যায়নি। তাই বর্তমান সরকার কর্তৃক সঠিকভাবে অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা আছে, যা প্রায় ৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার সমান। ২০০৮ সালে ছিল সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৫২ কোটি টাকা। সেই তুলনায় টাকা পাচার শত শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক বছরে। সরকারকে টাকা পাচার বা বিদেশের ব্যাংকে টাকা জমা রাখা বন্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে টাকা পাচার কমে আসবে। অতীতে ২০১৪ সালে বিদেশের ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক আলোচনা হয়। তখন বিগত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা জমা রেখেছে তা উদ্ধার এবং বের করা হবে। কেবল বেরই করা হবে না, দেশেও ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী সফলতা লক্ষ্য করিনি। তখন সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠানোর কথা ছিল। আর পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো টাকা তো ফেরত আসেনি বরং আরও পাচার করায় জমা টাকার পরিমাণ অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল। আরও নানা তথ্য প্রকাশ হচ্ছে, কিভাবে অবৈধভাবে টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, যা খুবই ভয়াবহ। যদি অসৎ ব্যক্তিরা এভাবে টাকা পাচার না করত তাহলে অনেক আগেই দেশ সোনার বাংলাদেশে পরিণত হতো।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর লন্ডনে ঘুরে এসেছেন দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য। এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কর্তৃপক্ষকে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে বা সিস্টেমে প্রবেশ করতে হবে যাতে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া সহজ হয়। বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ জমাদানকারীদের তথ্য পায়। সুইস ব্যাংকব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে। যার নাম হচ্ছে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন। ২০১৭ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময়ের এই আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। এই সিস্টেম শুরু হয়েছিল জি-২০ এবং ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশের হাত ধরে। মূলত এটি করা হয় কর ফাঁকি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। কোনো দেশের নাগরিক যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তা হলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে এই কাঠামোর আওতায়। এতে সহজেই তথ্য পাওয়া যায় এবং অসৎ ব্যক্তিদের কর ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করা যায়, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
এ ছাড়া তথ্য পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেরও রয়েছে একটি পৃথক আইন। ২০১০ সালে পাস করা যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট’-এ বলা আছে, কোনো মার্কিন নাগরিক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে অর্থ রাখতে চাইলে সে তথ্য তাদের দিতে হবে। আর তা না মানলে ওই ব্যাংককে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হবে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সুইস ব্যাংককে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা করলে সুইজারল্যান্ড স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান-প্রদানের একটি আইনি কাঠামোয় অংশগ্রহণ করতে সম্মতি জানিয়েছিল। এই ব্যবস্থায় কর ফাঁকি বা অন্য কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তির তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে তা দিতে বাধ্য সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে কেউ অর্থ পাচার করলে তথ্য পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যার সুফল পাবে দেশের জনগণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালে একবার সুইস ব্যাংকের নিকট তথ্য চেয়ে চিঠি প্রদান করেছিল। পরে যখন সুইস ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে তথ্য দেওয়ার আন্তর্জাতিক কাঠামোতে সম্মতি দেয়, তখন বাংলাদেশের তাতে যুক্ত হতে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখনো যদি যুক্ত না হয়ে থাকি, তাহলে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ পাচার বা জমা রাখার তথ্য প্রথম জানা যায় ২০০৪ সালে (উৎস-প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০২২)। তখনই যদি সরকার ব্যবস্থা নিত বা কঠোর হতো তা হলে আজকে আর এই অবস্থা দেখতে হতো না। আসলে অনেক রাজনীতিবিদ বিদেশের ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। তাই তারাও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চান না বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ তাদের তো তাতে বিদেশে টাকা জমা রাখা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিবছর হাজার হাজার টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, প্রবাসীরা কষ্ট করে টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। আর একশ্রেণির মানুষ বিদেশে টাকা পাচার করছে। এরা কিন্তু মানুষ নয়, বলব অমানুষ। কারণ এভাবে টাকা পাচার না হলে আরও অনেক বছর আগে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হওয়ার সুযোগ ছিল। যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজে লাগত।
সাধারণত প্রতি বছর জুন মাসে সুইস ব্যাংকের জমাকৃত টাকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। প্রকাশ পেলে কয়েকদিন গণমাধ্যমে খুবই আলোচনা এবং সমালোচনা চলে। তারপর হারিয়ে যায়। কার্যত কোনো কাজে আসে না। এ বছর প্রকাশ পেল, নানামুখী বিশ্লেষণ চলমান। প্রকৃতপক্ষে কোথা থেকে টাকা গেল, কার অর্থ গেল, তা জানার উদ্যোগ নেই। আমরা জানার চেষ্টাও করি না। অন্যান্য দেশ তাদের নাগরিকের সুইস ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ সহজেই জানতে পারে। আমরা কেন পারিনি, এটাই প্রশ্ন। আমরা কি ইচ্ছাকৃতভাবে জানার ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। কারণ টাকা পাচারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমরা অনেকেই কৌশলগতভাবে এড়িয়ে যাই। সর্বোপরি সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশিদের যে পরিমাণ বিপুল অর্থ অবৈধভাবে জমা রয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। তদুপরি অর্থ পাচার বন্ধে আরও কঠোর হতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
প্যানেল