ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

বৈরী আবহাওয়া আর ঋণের ফাঁদে দিশেহারা মৎস্যজীবীরা

আ: রহিম গাজী, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী 

প্রকাশিত: ২১:২৯, ২১ জুন ২০২৫

বৈরী আবহাওয়া আর ঋণের ফাঁদে দিশেহারা মৎস্যজীবীরা

ছবি: জনকণ্ঠ

গত ১২ জুন ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরার অনুমতি মিললেও এখনো স্বস্তি ফেরেনি উপকূলের হাজারো জেলে পরিবারে। বঙ্গোপসাগরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেকে সমুদ্রে নামতেই পারেননি। আবার যারা গিয়েছেন, তাদের অনেকেই ফিরেছেন খালি হাতে। ফলে জেলেদের জীবনে জমেছে হতাশা, বাড়ছে ঋণের বোঝা। বৈরী আবহাওয়া আর একের পর এক সরকারি নিষেধাজ্ঞায় দিশেহারা উপকূলের হাজারো জেলে পরিবার।

৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন এবার রূপালী ইলিশে ভরবে তাদের জাল, ফিরবে সুখের দিন। কিন্তু সাগরে পা দিতেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঝড়ো হাওয়া আর উঁচু ঢেউ। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, কলাপাড়ার জেলেরা জানিয়েছেন, অনেকে এখনো সাগরে নামার ঝুঁকি নিতে পারছেন না।

রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের জেলে রফিক হাওলাদার বলেন, “পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার বাজার করে ১৫ দিনের উদ্দেশ্যে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাগরে মাছ নেই। ঢেউয়ের জন্য জালই ঠিকভাবে ফেলা যায় না, মাছ থাকবেই বা কী করে? তিন-চার বার জাল ফেলেছি। প্রতিবারই একই অবস্থা। তাই সমুদ্র থেকে জাল উঠিয়ে চলে এসেছি।”

তবে রাঙ্গাবালী উপজেলা মেরিন ফিশারিজ অফিসার এস এম শাহাদাত হোসেন রাজু জানান, “নিষেধাজ্ঞার পর সাগরে মাছ থাকার সম্ভাবনা থাকলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জেলেরা ঠিকমতো জাল ফেলতে পারছেন না। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাছ ধরা পড়ছে না। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে মাছ ধরা বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।”

উপকূলীয় অঞ্চলে বছরে গড়ে ৮–৯ মাস জেলেদের মাছ ধরা কার্যত বন্ধ থাকে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, কালবৈশাখীসহ নানা দুর্যোগে প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায় সমুদ্রযাত্রা। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২৫০–২৭০ দিন পর্যন্ত কোনো না কোনো কারণে মাছ ধরা বন্ধ থাকে উপকূলীয় এলাকায়। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার নিম্নআয়ের মাছনির্ভর পরিবারগুলোর ওপর।

পটুয়াখালী জেলার সমুদ্রসংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে প্রায় দেড় লাখ জেলে রয়েছেন। বারবার নিষেধাজ্ঞা আর আবহাওয়ার কারণে আয় না থাকায় অনেক পরিবারই ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। খাদ্য সহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় জীবন চালানোই হয়ে উঠেছে কঠিন।

রাঙ্গাবালীর জেলে আলাউদ্দিন মাঝি বলেন, “জেলে পেশা ছাড়তে চাইছি। কিন্তু ছাড়ব কীভাবে, অন্য কাজ তো নেই। অন্য কোনো কাজ পেলে মাছ ধরা ছেড়ে দেবো।”

রাঙ্গাবালীর জেলে হারুন মাঝি বলেন, “৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখন ঘরে বসে ছিলাম। ঠিকমতো বাজার সদাই করতে পারিনি। এখন আবার আবহাওয়া বিপর্যয় করছে। এরকম হলে কীভাবে বাঁচব? মাছ ধরা ছেড়েই বা কী করব? ছোটকাল থেকে শিখেছি এই কাজ, অন্য কিছু পারি না। মহাজনও টাকা দিতে পারছে না। তাই আবার ঋণ করে সংসারের বাজার কিনেছি। এইভাবে আর কত? তাই চিন্তা করছি আবহাওয়া যতই খারাপ হোক, কালই সাগরে যাব।”

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ফিশারিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, “শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব নয়, যদি মানুষ বাঁচতে না পারে। মানুষ বাঁচলেই প্রকৃতি বাঁচবে। সাগরের মাছ রক্ষার আগে সাগরের মানুষকে রক্ষা করতে হবে।”

শহীদ

×