ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

তথ্য হবে আগামীর পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র

মো. হাসনাইন রিজেন

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২১ জুন ২০২৫

তথ্য হবে আগামীর পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র

‘তথ্য’ একসময় ছিল জ্ঞান অর্জনের উপায়, গণতন্ত্রের হাতিয়ার, মানুষের উন্নয়নের সিঁড়ি। তথ্যের ভিত্তিতেই মানুষ নিজের অবস্থান বুঝত, সমাজের পরিবর্তন চাইত এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করত। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন তথ্য এক ধরনের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে । অনেকটা আগ্নেয়াস্ত্র বা পারমাণবিক বোমার মতোই শক্তিশালী। বরং অনেক সময় তার চেয়েও ভয়ংকর। আজকের পৃথিবীতে, বিশেষত যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে, এটি রূপ নিচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্রে। আগ্নেয়াস্ত্র, পারমাণবিক বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র নয়, আজ যেই অস্ত্র সবচেয়ে গোপনে, নিঃশব্দে এবং অদৃশ্যভাবে ধ্বংস ঘটাতে পারে- তা হলো তথ্য। তথ্য নিয়ন্ত্রণ, বিকৃতি, চুরি বা অপব্যবহার করে একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আগ্নেয়াস্ত্র শত্রুকে দেখে আঘাত করে কিন্তু তথ্য আঘাত করে নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে, ভিতর থেকে।
তথ্য এখন শুধু কোনো ঘটনা জানানোর উপায় নয়, এটি হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। রাজনীতি, যুদ্ধ, কূটনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি এখন তথ্য। কে কোন তথ্য রাখছে, কে কোন তথ্য পাচ্ছে না, কে কোন তথ্য বিকৃত করছে- এই গেমটাই ঠিক করে দিচ্ছে কে জয়ী হবে, কে পরাজিত। আমরা একে বলি ‘ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার’ বা তথ্যযুদ্ধ। এটি এমন এক যুদ্ধ যেখানে গোলা-বারুদ নেই। তাপরও সৃষ্টি হয় ধ্বংস আর ধ্বংস। বোমা ফাটে না কিন্তু সমাজ ছিন্নভিন্ন হয়।
তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখার ঘটনা এখন নিয়মিত দেখা যায়। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাদের ধারণা ছিল রাশিয়ার ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। ভুল তথ্য ছড়ানোর  মাধ্যমে তারা যুদ্ধের জন্য রাশিয়া দায়ী নয় এমন মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করতেছে। অন্যদিকে রাশিয়া নিজেদের জনগণের মাঝেও একই মনোভাব তৈরি করতে তথ্য ছড়িয়ে দেয় তাদের টেলিভিশন খবরগুলোতে। রাশিয়া তথ্যকে নিজেদের মতো গড়ে নেয়। যার মাধ্যমে বহির্বিশ্ব এবং নিজেদের জনগণের কাছে তারা নির্দোষ থাকতে পারছে।
আমরা যদি গত বছরের জুলাই আন্দোলন বা তার আগের সময়ের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো বিগত সরকারও তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখা চেষ্টা করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি এবং অর্থ পাচের মত ঘটনা আড়াল করতে সব সময় মিডিয়া পর্দায় উন্নয়নে কথা বলে গেছে। অথচ উন্নয়নের নামে দেশ থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে সেই তথ্য জাতির সামনে প্রকাশিত হয়নি।
বর্তমানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের গাজা যুদ্ধেও আমরা দেখি কিভাবে তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ সেটা বিশ্বের সবাই অবগত। সেখানকার তথ্য  বিশ্ববাসীর সামনে উঠে আসছে নাগরিক সাংবাদিকতা, মোবাইল ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যেমে। আবার ইসরাইল নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে রকেট হামলার ছবি।
এখানে তথ্য যুদ্ধ শুধু দুই পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে এটি সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
একটি রাষ্ট্র যখন তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় বা প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে তথ্য ব্যবহার করে তখন শুধু বাহ্যিক শত্রু নয়, রাষ্ট্র নিজেই নিজের নাগরিকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর উদাহরণ হতে পারে ২০১১ সালের আরব বসন্ত। সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য ব্যবহার করে সেদিন তিউনিশিয়া থেকে মিশর, লিবিয়া পর্যন্ত সরকার পতনের ঢেউ উঠে যায়। কিন্তু একই প্রযুক্তি, কয়েক বছর পর ব্যবহার হয়েছে জনসাধারণকে দমন করতে।
সম্প্রতি ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের হত্যা এই তথ্যর মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। নিখুঁতভাবে যে কোনো টার্গেট ঠিক করতে হলে প্রয়োজন পরে নির্ভুল তথ্য। এছাড়া তথ্যের বিকৃতি বা ‘মিসইনফরমেশন’ এর মাধ্যমে যে কোনো পরিস্থিতি পরিবর্তন করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। আগামীর পৃথিবীর যুদ্ধ, না হবে মাটিতে  না আকাশে, হবে মস্তিষ্কে। তথ্যই হবে সেই যুদ্ধের বুলেট, সার্ভার হবে অস্ত্রাগার। আর মানুষের বিশ্বাস? সেটাই হবে এই যুদ্ধের আসল লক্ষ্য।
তথ্যযুদ্ধ এমন এক খেলা, যেখানে পরাজয় শুধু রাষ্ট্রের নয়, মানুষেরও হয়। হয় সাধারণ জনগণের, শিক্ষার্থীর, চিকিৎসকের, এমনকি শিশুরও। তথ্য যখন অস্ত্র হয়, তখন প্রতিরক্ষা হয় সতর্কতা, শিক্ষা ও নৈতিকতা। তথ্যের এই যুদ্ধ ঠেকাতে হলে রাষ্ট্রকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনগণের তথ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায়, আমরা সবাই হয়ে পড়ব এক অদৃশ্য যুদ্ধের বন্দি। যেখানে বন্দুকের গুলি নেই, কিন্তু ক্ষত হয়ে যায় পুরো সমাজ।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×