ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

দেশীয় ফলের বাণিজ্যিক চাষ

গোরা বিশ্বাস

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ২১ জুন ২০২৫

দেশীয় ফলের বাণিজ্যিক চাষ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নীলাভূমি আমাদের এই চির সবুজের বাংলাদেশ। এখানে রয়েছে হাজার নদীর অববাহিকা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, গাছপালা, নদীনালা। আরও রয়েছে নানা প্রজাতির পশু-পাখি, রং-বেরঙের ফুলফলের সমাহার। এদেশের মাটি পৃথিবীর যে কোনো দেশের মাটির চেয়ে উর্বরতায় পিছিয়ে নেই। এদেশের আবহাওয়া ও মাটি কৃষিকাজ ও বৃক্ষরোপণের জন্য উপযোগী হওয়ায় পশুপাখির ও মানুষের মাধ্যমে ছড়ানো ফলের বীজ  থেকে গাছ জন্মে। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশে বছরের একেক ঋতুতে একেক ধরনের ফলের আধিক্য দেখা যায়। তবে দেশী ফলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ- এই দুই মাস আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, আনারস, খেঁজুর এসব ফলের ভরা মৌসুম বিধায় বাজারে প্রচুর ফলের সরবরাহ থাকে। দামও থাকে ল্ডয় ক্ষমতার মধ্যে। এ কারণে জ্যৈষ্ঠ মাসকে মধুমাসও বলা হয়। দেশীয় আম, কাঁঠাল খুবই রসালো ও সুস্বাদু বলে সব বয়সের মানুষের কাছে ফল দুটি প্রিয় ও পছন্দের। আম, কাঁঠাল ছাড়াও দেশীয় ফলের মধ্যে আরও রয়েছে পেয়ারা, কমলা, জাম্বুরা, বেল, আপেলসহ এ ধরনের প্রায় ১০০টির মতো দেশীয় ফল। বর্তমানে দেশে ৭০ ধরনের ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে আবার ১০-১২ প্রজাতির ফলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রায় ১২ প্রজাতির ফল নিয়মিত দেশের মানুষ খেয়ে থাকেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) এক তথ্যমতে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ ফলের মোট উৎপাদনে ১০ম স্থানে রয়েছে। জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য পুষ্টি সরাবরাহ নিশ্চিত করা। খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য অংশ হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য ও ফল উৎপাদন করা। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৩৩ হাজার জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল। তাতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৪৩.৩১২ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ সালে সেই লক্ষ্য মাত্রা বেড়ে দেশে মোট ৭ লাখ ৬৫ হাজার জমিতে ফলের উৎপাদন হয়েছে ১৫০.৩৩ লাখ মেট্রিক টন। তাই মৌসুমী ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ১০টি দেশের তালিকার মধ্যে রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, আম উৎপাদনে ৯ম, পিয়ারা উৎপাদনে ১০ম স্থানে রয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর এক তথ্য মতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফল মূল রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ১ মিলিয়ন ডলার। ঋঅঙ -এর এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০ বছরে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২০ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের ফল উৎপাদনে সম্প্রতি অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। কয়েক দশক আগেও পাহাড়ে কোনো ফল চাষ হতো না। কিন্তু কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ২০০৪ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বহু রকমের ফলের বাগান ও চাষ শুরু হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ফল চাষের জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ হেক্টর। সারাদেশে উৎপাদিত ফলের ১৫% আসে এই তিন পার্বত্য অঞ্চল থেকে। ফল উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল রয়েছে। আনারস উৎপাদনে মধুপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিখ্যাত। আম ও লিচু উৎপাদনের জন্য রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর সবচেয়ে বেশি উপযোগী। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য রয়েছে গাজীপুর, মধুপুর বিখ্যাত। এ ছাড়াও আর একটি মুখরোচক ফল রয়েছে যার ডাক নাম বরই, প্রচলিত নাম কুল। কুলের মধ্যে কুমিল্লার চিনিগুড়া, বল সুন্দরী, সাতক্ষীরার নারিকেল ও আপেল কুল বিখ্যাত। তবে এর মধ্যে আপেল কুলের চাহিদা ল্ডেতাদের নিকট সবচেয়ে বেশি। দেশীয় ফলের মধ্য লটকন একটি জনপ্রিয় ফল হিসেবে পরিচিত। এই লটকন সাধারণত বর্ষা মৌসুমে পাওয়া যায় বিধায় একে মৌসুমী ফল বলা হয়। এই দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের বাইরেও অনেক ফল রয়েছে। যেমন- ডেওয়া, করমচা, আতা, মুনাফল, চালতা, জগডমুর এরকম প্রায় ১৫ থেকে ২০টির মতো ফল রয়েছে যা বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও গ্রামগঞ্জে এখনো পাওয়া যায়। এই ফলগুলো খেতে খুবই মজাদার ও পুষ্টি গুণে ভরপুর থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য কৃষকরা তেমন ঝুঁকছেন না।
বাংলার এই চিরপরিচিত ফলগুলো যাতে হারিয়ে না যায় এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভুলে না যায় সে জন্য কৃষি বিভাগকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এ জাতীয় দেশীয় ফলগুলো আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অতপ্রোতভাবে মিশে আছে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্মার্ট কৃষির যুগে প্রবেশ করেছে। স্মার্ট কৃষির যুগে এসে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তার দিকে সরকারকে যেমন নজর দেওয়া জরুরি তেমনি ফলমুলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা বাড়ানো আবশ্যক। ফল পচনশীল পণ্য। তাই ফল চাষিদের প্রয়োজনের তাগিদেই পর্যাপ্ত পরিমাণে হিমাগার তৈরি করতে হবে। যে কোনো ফলের চাহিদা ও মূল্যমান নির্ভর করে ভোক্তার চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। তাই ফলের মান যতই ভালো হোক না কেন, তা ভোক্তার হাতে নিরাপদে না পৌঁছলে কৃষকরা ভালো দাম পাবেন না। বাংলাদেশে এখনো ফল সংরক্ষণের অভাব এবং বাগানের নানা রোগ বালাই দূর করতে না পারার কারণে চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,  দেশে উৎপাদিত ফল ও শাক সবজি অপচয় হচ্ছে মোট উৎপাদনের ২৫ থেকে ৪০ ভাগ। বর্তমানে উৎপাদিত ফল ও শাক সবজির মাত্র ১ ভাগ দেশীয় ১৪টি শিল্প কারখানায় প্রল্ডিয়াজাত করার সুযোগ রয়েছে। মানবদেহের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ঘি, মাখন যেমন প্রয়োজন তেমনি বিষমুক্ত টাটকা শাক সবাজি ও ফলেরও প্রয়োজন রয়েছে। ডঐঙ এবং  ঋঅঙ -এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ভিটাক্যারোটিন ফুলেট এন্টিঅক্সিডেন, লাইকুফোন ছাড়া ও এই ধরনের আরও অনেক উপাদান রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ফল থেকে অর্থ পুষ্টি দুই-ই আসে। কাজেই ফলের চাষ বৃদ্ধি ও খাওয়ার অভ্যাস করা প্রয়োজন।
একসময় মানুষ বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ফলের গাছ লাগিয়ে চাহিদা মেটাতেন। কিন্তু আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ঐ প্রাচীন আমলের কৃষি উৎপাদন প্রল্ডিয়ায় পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাতের ফলের চাষ করা সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে প্রতি বছর সরকার জাতীয় ফল মেলার আয়োজন করে থাকে। এই মেলার মাধ্যমে যেমন সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ফলের পুষ্টি ও গুনাগুন সম্পর্কে ধারণা হবে তেমনি ফল চাষীরাও ফল উৎপাদনে অনুপ্রণিত ও উদ্যোমী হয়ে উঠবেন। বাংলার ফল শুধু খাদ্য, পুষ্টির চাহিদাই মিটায় না, আমাদের ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার ফল নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, ছড়া, গল্প ও গান। শেষ করব সেই সব কবি সাহিত্যিকদের রচনায় উঠে আসা তেমন কিছু কবিতা ছড়ার উদ্ধৃতি দিয়ে। যেমন ছোটদের জন্য রচিত ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ/ পাকা জামের মধুর রসে রঙ্গিন করি মুখ। কিংবা আম কাঁঠালের বনের ধারে মামার বাড়ির ঘর/ আকাশ থেকে জ্যোছনা কুসুম ঝড়ে মাথার পর। ফুলে ভরা ফলে ভরা আমার এ দেশ ভাই...। এই রকম শত শত ফুল ফলের উপমা অলংকারে রূপসী বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। আর এভাবেই ব্যবসার গন্ডি ছাড়িয়ে কৃষকের জমিন থেকে উঠে এসে কবি সাহিত্যিকদের কলমের ডগায় স্থান করে নিয়েছে এই দেশের বাহারী ফুল ফল।
লেখক : পরিবেশকর্মী

প্যানেল

×