
জীবনটা গল্পের মতো নয়। জীবন কাহিনী দিয়ে গল্প বানানো যায়, কিন্তু গল্পের মতো জীবন হয় না। গল্প বা সিনেমায় বাস্তবতাকে যতটা কঠিন হিসেবে দেখানো হয়, আসলে বাস্তবতা তার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন। সত্যি কথা বলতে কি জীবনের মোড় কখন যে কোন দিকে যাবে তা স্বয়ং বিধাতা ছাড়া আর কেউ জানে না। কথায় আছে, জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। তবু তো জীবন। কখনো সুখের কখনো দুঃখের। তাই বলে থেমে থাকে না। আপন গতিতে এগিয়ে চলে। ইদানীং মাঝেমধ্যেই মনে হয়- জীবন যেন ভুলে ভরা এক মস্ত বই। পাতায় পাতায় রাশি রাশি ভুল। পেছনে ফেরা যাবে না। শোধরানোরও কোনো উপায় নেই। তারপরও মনে হয়, আবার যদি জীবনটা প্রথম থেকে শুরু করা যেত তাহলে কী দারণই না হতো! সব ভুল শুধরে নিতে পারতাম। কিন্তু তাতো আর হওয়ার নয়। তবে সবসময় আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি। কখনো ভাবি না জীবনে কী হারিয়েছি। বরং ভাবি জীবনে কী পেয়েছি। তখন মহান আল্লাহ পাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে ওঠে।
ছোট বেলায় একটি ইংরেজি প্রবাদ বাক্য শিখেছিলাম। ‘ঞড় বৎৎ রং যঁসধহ’ অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গেলে ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ভুল করে অনেকে পার পেয়ে যান, আবার অনেককে ভুলের মাশুল গুনতে হয়। ছোট বেলায় স্কুলে ভুল বানান লিখতে গিয়ে একটা ভুল করেছিলাম এবং তার জন্য শাস্তিও পেয়েছিলাম। পণ্ডিত স্যারের ক্লাসে ভুল বানান লিখেছিলাম ‘ভুল’। স্যার বোর্ডে একটা বাক্য লিখে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন ওই বাক্যটা লিখে দশবার তাকে দেখাতে হবে। বাক্যটা ছিল, ‘ভুল বানান লিখিতে জীবনে আর কোন দিন ভুল করিয়াও ভুল করিব না’। মনে হয় আর কোন দিন ভুল বানান ভুল হয়নি। জীবনে চলার পথে হাজার বার ভুল করেছি, হাজার বার হোঁচট খেয়েছি। তবে তা নিয়ে কখনই চিন্তিত হইনি বরং গর্বিত হয়েছি। প্রত্যেকটি ভুল আমাকে আরও পরিণত করেছে, নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও মসৃণ হয়েছে। কিন্তু জীবন নামের নৌকা কী সবসময়ই ঠিকমতো চলে? কখনো কখনো পাল্টে যায়। সিনেমায় দেখতাম মনস্টার আসছে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে যে এমন পৃথিবী দেখতে হবে না তা কে বলতে পারে?
জীবনে এতটা অখণ্ড অবসর আসবে ভাবতেও পারিনি। পড়াশোনাই যেন হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। যতই পড়ি ততই মনে হয় জানার পরিধি কতই না সীমাবদ্ধ। আরও কত কিছু জানার আছে, শেখার আছে। এই অখণ্ড অবসর জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। আগে বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমিত্বকে কখনই অনুভব করার সুযোগ পেতাম না, যা এখন পারছি। আসলে জীবনের প্রতিটি স্টেজেই রয়েছে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ও গুরুত্ব। সব মুহূর্তই অনুভব করার চেষ্টা করি। পারস্যের কবি শেখ সাদী বলেছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত, কারণ কাল কী হবে কেউ জানে না।
শখের বসে লেখালেখি করার চেষ্টা করি। আর এটাও বুঝি যে, সত্যিকারের লেখক হওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার, যা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমার অনেক দোষ-ত্রুটি রয়েছে। আমি কখনো পারফেক্ট নই। এই পৃথিবীটাই একটা ইমপারফেক্ট জায়গা। যেখানে শতভাগ পারফেক্টনেস আশাও করা যায় না। কোনো বিষয়ে বেশিক্ষণ লেগে থাকতে পারি না- এটাই আমার বড় দোষ। পাশাপাশি ভুল করাও যেন সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের অজান্তেই অনেক ভুল করে থাকি। তবে ভুল থেকে শিখেছিও অনেকে। আবারও ভুল করেছি। আবারও শিখেছি। আসলে কাজের যেমন শেষ নেই ভুলেরও তেমন শেষ নেই। ভুল জীবনেরই একটি অংশ। ভুল করার প্রয়োজন আছে। কেননা ভুল না করলে আমরা সঠিকটা জানতে পারি না।
এই ভুলেরও যে গুণ রয়েছে এর একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরছি। লি কুম নামের এক অল্পবয়সী রাঁধুনী থাকতেন চীনের দক্ষিণাঞ্চলে। উপকূলীয় অঞ্চলে ছিল তার বাস। একদিন চুলায় স্যুপ বসিয়ে বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। স্যুপ জ্বাল হতে হতে এক সময়ে উপচে পড়তে থাকে। একেবারে ঘন হয়ে যায় সেই স্যুপ। তখন ওই রাঁধুনীর মাথায় হাত দেওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু কৌতূহলবশত একটু চেখে দেখতে গিয়ে তিনি দেখলেন, অতিরিক্ত জ্বাল দেওয়া ওই ঘন বস্তুটির অসাধারণ এক স্বাদ। আর তখনই পাত্রে ভরে ওই স্যুপ বিক্রি করার ভাবনা তার মাথায় চেপে বসে। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একটি ভুল থেকে তৈরি হওয়া স্যুপ বিক্রি করে রাতারাতি ধনী বনে যান লি কুম ও তার পরিবার। বর্তমানে হংকংয়ের চতুর্থ সর্বোচ্চ ধনী এই পরিবার। তাহলে এবার বুঝে দেখুন একটি ভুলের কত গুণ! ব্যক্তিগত জীবন থেকে করপোরেট জীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবখানেই আমরা ভুল করি হরহামেশা। ভুল মানেই ব্যর্থতা নয়। ভুল মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়।
পৃথিবীতে কেউ কারও মতো নয়। সবাই আলাদা। সত্তা আলাদা, চিন্তা আলাদা, ব্যক্তিত্ব আলাদা, চেহারাও আলাদা। যখন নিজেকে নিয়ে ভাবি তখন বুঝতে পারি আমিও অন্য সবার থেকে আলাদা। কিন্তু আলাদা হলেও যখন দেখি অন্য কারোর মন মানসিকতার সঙ্গে মিলে যায় তখনই আমরা তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। তা না হলে মানুষ হয়তো বাঁচতেই পারত না। মানুষের সঙ্গী দরকার হয়। তাই সে চিরদিন কল্পনায় মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায় কী! মাঝে মাঝে এসব এলোমেলো চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। তখন নিজেকেই নিজে চিনতে পারি না, হারিয়ে ফেলি। কখনো কখনো অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে বসি। তখন নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত হই। নিজের ভেতর অসংখ্য দোষ-ত্রুটি আবিষ্কার করি। অন্যের চোখে ধরা না পড়লেও নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। এই আত্মবিশ্লেষণ আমাকে বিমূঢ় করে দেয়। ভাবি এক জীবনে কত ভুলের পাহাড় জমে গেছে। ভুলগুলো যত বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তা ততই চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। তবে কখনো অনুশোচনা করি না। বরং মনে মনে মনীষীদের কথা ভাবি যারা বলেছেন, যে যত বেশি ভুল করে সে তত বেশি পরিণত হয়। এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি।
সত্যি কথা বলতে কি, কাজ করতে গেলে ভুল হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল হওয়াটাই জীবনের শেষ কথা নয়। বরং ভুলের ব্যর্থতা থেকে ফিরে আসাটাই মূল কথা। এ বিষয়ে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক এডমন্ডসন একটি বই লিখেছেন, নাম ‘রাইট কাইন্ড অব রং’। তাতে তিনি বলেছেন, এই দুনিয়ার কর্মক্ষেত্র বড়ই জটিল। সফল হতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। ভুলভ্রান্তি বা ব্যর্থতা অতি স্বাভাবিক বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো ভুল বা ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে সেটিকে ঠিক মতো বিশ্লেষণ করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করলেই ভবিষ্যতে ভুল বা ব্যর্থতা এড়ানো যাবে। কানাডিয়ান বিখ্যাত লেখক রবিন শর্মা বলেছেন, ভুল বলে কিছু নেই, সবই নতুন শিক্ষা। তিনি আরও বলেছেন, যে কখনো ভুল করেনি তার মানে সে চেষ্টাই করেনি। তবে সব কথা ছাপিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার উক্তিটিই আমাকে বেশি উদ্বুদ্ধ করে, তা হলো- দক্ষতা তৈরি হয় অভিজ্ঞতা থেকে। আর অভিজ্ঞতা আসে ভুলভ্রান্তি থেকে। তাই ভুল করা কোনো খারাপ জিনিস নয় বরং সাফল্যের প্রথম চাবিকাঠি।
জাপানের একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো- ‘যদি কখনো ভুল ট্রেনে উঠে পড়ো তাহলে পরবর্তী স্টেশনে নেমে যাও। কেননা ট্রেন যত দূরে যাবে ততই ফেরার কষ্ট বাড়বে’। কথাটা আসলে আমাদের জীবনে অনেকটাই বাস্তব প্রতিফলন। ভুল করে ভুল ট্রেনে উঠে পড়াটা আমাদের জীবনের জন্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ছোট্ট জীবনে চলার পথে অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্তই আমাদের গ্রহণ করতে হয়। প্রতিটি সিদ্ধান্তই যে সঠিক হবে তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। বলতে গেলে জীবনে সঠিক সিদ্ধান্তের চেয়ে ভুল সিদ্ধান্তটাই আমরা বেশি নেই।
আমি এমনি এমনি বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। কিছুটা বেখেয়ালিও বটে। সত্যি কথা বলতে কি অন্যদের মতো এত স্মার্ট নই, কিছুটা পিছিয়ে পড়া মানুষ। কোনো কিছুই পরিকল্পনামাফিক করতে পারি না। তা-ই নিজের অজান্তেই অনেক ভুল করে থাকি। আর এর জন্য সাফারও কম করি না। তার পরও ভুল করার সপক্ষে যুক্তি খুঁজি। মনে মনে ভাবি, ভুল ট্রেনে উঠে ভুল স্টেশন নেমে যাওয়ার মাঝেও এক ধরনের আনন্দ আছে। এক হলো সঠিক পথে আসার আনন্দ। দুই, ভুল বুঝতে পারার আনন্দ। আর তিন হলো, ভুল সময়ে আপন মানুষদের চিনতে পারার আনন্দ। কেউ যদি সবসময় কোনো ভুল না করে সঠিক কাজই করতে থাকে, তাহলে সে এ আনন্দগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। তবে আশার কথা এই যে, সৃষ্টিকর্তা আমাদের কোনো আনন্দ থেকেই বঞ্চিত করে না।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
প্যানেল