
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি সরকারের পতনই ঘটায়নি, বরং আমাদের সংবিধানের কার্যকারিতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই আন্দোলনে ১০০০-এর বেশি মানুষের প্রাণহানি এবং ২০,০০০-এর বেশি আহত হওয়ার ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আমাদের সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় অপর্যাপ্ত। আবু সায়েদের মতো নিরস্ত্র ছাত্রের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ এবং পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতা সংবিধানের কার্যকারিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে। এই বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে: আমাদের সংবিধান কি প্রকৃতপক্ষে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, নাকি এটি ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদকে বৈধতা দেওয়ার উপকরণ মাত্র?
বাংলাদেশের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলস্রুতিতে এই রাষ্ট্রের জন্ম, সেই 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটিই সংবিধানে অনুপস্থিত। সংবিধানের প্রস্তাবনায় কেবল "জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ" উল্লেখ রয়েছে, যা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি কেবল আবেগের বিষয় নয়, বরং সাংবিধানিক স্বীকৃতির একটি মৌলিক প্রশ্ন।
জাতিগত পরিচয় নিয়েও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সংবিধান অনুযায়ী আমরা জাতি হিসেবে 'বাঙালি', কিন্তু নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশি'। এই দ্বৈততা শুধু শব্দগত নয়, বরং এটি বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ অসংখ্য জাতিগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং আজও এই ভূমিতে বসবাস করছে, তারা সাংবিধানিকভাবে 'বাঙালি' নন। সংবিধানে কেবল 'বাঙালি' জাতির উল্লেখ করে এই সকল জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা সাংবিধানিক সমতার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭খ ধারা সংযোজন করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিধানটি মৌলিক কাঠামো তত্ত্বের দোহাই দিয়ে প্রণীত হলেও এটি মূলত জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর আঘাত হানে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের যে ক্ষমতা থাকার কথা, তা খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এর দ্বারা সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদের বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতাকেও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, যা সর্বোচ্চ আদালতের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা অপরিবর্তনীয় থাকবে। বরং এটি একটি জীবন্ত দলিল, যা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এগুলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অধীনে রাখা হয়েছে, যা আদালতে প্রয়োগযোগ্য নয়। অর্থাৎ একজন নাগরিক এই অধিকারগুলোর জন্য আদালতে যেতে পারেন না। একদিকে সংবিধানে জীবনের অধিকার প্রয়োগযোগ্য, অন্যদিকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের অধিকার প্রয়োগযোগ্য নয়—এই পরস্পরবিরোধিতা স্পষ্টতই অযৌক্তিক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদ্যের অধিকারের প্রত্যক্ষ সাংবিধানিক স্বীকৃতি জনগণের এই অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকারের সুযোগ দেবে এবং সরকারি পদক্ষেপের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে।
আবার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য তার দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন বাতিল হয়ে যায়। গবেষকদের মতে, এই অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রকে পিছিয়ে দিচ্ছে এবং সংসদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে। এই বিধানের ফলে সংসদে বিতর্ক ও মতের স্বাধীনতা খর্ব হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ ছিল সংসদের অকার্যকারিতা। যে সংসদ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর কথা, সেই সংসদ হয়ে উঠেছিল সরকারি সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়ার যন্ত্র মাত্র।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে যে, আমাদের সংবিধান ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে অকার্যকর। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই গণঅভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং সহিংসতা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিধানগুলোকে সম্পূর্ণ অর্থহীন করে তুলেছিল। বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ) এর সহ-সভাপতি মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ সাম্প্রতিক এক আলোচনা সভায় মন্তব্য করেন, "স্বৈরাচারী শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী মতের প্রতি দমনমূলক পদক্ষেপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সৃষ্টি করেছিলো জনগণের মনে হতাশা এবং তীব্র হয়েছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান।"। এই পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আমাদের সংবিধান কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিরোধে অপর্যাপ্ত।
আমাদের নতুন সংবিধানে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ স্বীকৃতি থাকতে হবে। জাতিগত পরিচয়ে শুধু 'বাঙালি' নয়, বরং 'বাংলাদেশি' হিসেবে সকল জাতিগোষ্ঠীর সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো হতে হবে প্রয়োগযোগ্য অধিকার, যার জন্য নাগরিকরা আদালতে যেতে পারবেন। সংবিধানের অপরিবর্তনীয়তার বিধান প্রত্যাহার করে এটিকে একটি জীবন্ত দলিলে পরিণত করতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের মতো গণতন্ত্রবিরোধী বিধান বাতিল করে সংসদে প্রকৃত বিতর্ক ও মতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, আমাদের প্রত্যাশিত সংবিধান হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের সংবিধান—যা হবে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রতীক। যে সংবিধান নিশ্চিত করবে যে, আবু সায়েদের মতো আর কোনো নিরপরাধ তরুণকে অন্যায্য শাসনের বিরুদ্ধে প্রাণ দিতে হবে না। সেই সংবিধানই পারবে বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে।
Jahan