
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নিঃশব্দ প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার শতাব্দী প্রাচীন মির্জাপুর শাহী মসজিদ। মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীতে গড়া এই মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং সময়ের সাক্ষ্য হয়ে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস।
ইতিহাসের পাতায় ফিরে দেখা:
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মসজিদটি নির্মিত হয় ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, মুঘল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে। মসজিদের গায়ে থাকা ফারসি শিলালিপি ও তার নকশায় প্রতিফলিত নিখুঁত কারুকাজ মুঘল শিল্পকলার উপস্থিতি দৃশ্যমান করে। যদিও নির্মাতার বিষয়ে রয়েছে ভিন্নমত কেউ বলেন মালিক উদ্দীন, কেউ বলেন দোস্ত মোহাম্মদ তবে সকলেই একমত, এটি কোনো সাধারণ ধর্মীয় স্থাপনা নয়।
স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য:
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট এবং প্রস্থ ২৫ ফুট। একটি সারিতে তিনটি গম্বুজ, এবং নিচে সমান্তরাল তিনটি প্রবেশদ্বার। চার কোণায় মিনারাকৃতির স্তম্ভ রয়েছে, যা স্থাপত্যে ভারসাম্য ও শৈল্পিক সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। মসজিদের দেয়ালজুড়ে খচিত লতাপাতা, ফুল ও জ্যামিতিক অলংকরণ এখনো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।
ভেতরে প্রবেশ করলে শীতল পরিবেশ এবং নিস্তব্ধতা যেন এক ধরনের পবিত্রতাবোধ এনে দেয়। বিশেষ করে কিবলামুখী দেয়ালের অলঙ্করণে ফুটে উঠেছে প্রার্থনার স্থিরতা এবং শিল্পের গভীরতা।
জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক কল্পকথা:
স্থানীয় প্রবীণদের মুখে মুখে চলে আসা কথায় জানা যায়, কোনো এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মসজিদটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ইরান থেকে কারিগর এনে সংস্কার করা হয়। যদিও এই তথ্যের কোনো লিখিত প্রমাণ নেই, তবে লোককাহিনিতে বিষয়টি বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, মসজিদের নিচে রয়েছে গুপ্তধন যা ঘিরে বহু রকমের রোমাঞ্চকর গল্প ছড়িয়ে রয়েছে এলাকায়।
ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগ দরকার:
বর্তমানে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ নয়। ঐতিহাসিক এই নিদর্শনের পাশে নেই কোনো দর্শনীয় তথ্য ফলক, পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা বা ট্যুর গাইড। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এর ডিজিটাল সংরক্ষণ ও প্রচার, এবং একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নয়ন সম্ভব।
সংস্কৃতি, লোকাচার ও বিশ্বাসের মিলনমেলা:
প্রতিবছর আশ্বিন মাসে মির্জাপুর গ্রামে আয়োজিত হয় স্থানীয় লোকমেলা। আশপাশের গ্রামের মানুষ এসে মসজিদে জিয়ারত করে, দোয়া চায়। কেউ কেউ মনোবাসনার পূরণে এখানে মানত করে থাকে। এভাবেই ধর্মীয় অনুভব, লোকাচার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক হয়ে তৈরি করে এক অনন্য আবহ।
অতীতের আয়নায় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা:
প্রায় চার শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মির্জাপুর শাহী মসজিদ কেবল ইট-পাথরের একটি স্থাপনা নয়, এটি হলো সময়ের দলিল, ইতিহাসের নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর। এর প্রতিটি গাঁথুনিতে মিশে আছে মেহনতি কারিগরের নিষ্ঠা, মুসলিম সংস্কৃতির গৌরব এবং ইতিহাসের অবিচ্ছিন্ন ধারা।
নতুন প্রজন্মের উচিত এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব বোঝা, সংরক্ষণে এগিয়ে আসা। শুধু সংরক্ষণ নয়, উপস্থাপন এটিই পারে মির্জাপুর শাহী মসজিদকে দেশের উত্তরাঞ্চলের এক উজ্জ্বল গন্তব্যে পরিণত করতে।
মির্জাপুর শাহী মসজিদ যেন কালের সীমানা অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিরব বার্তাবাহক, যে বলছে "আমরা ছিলাম, আছি, থাকব ইতিহাস হয়ে, পরিচয় হয়ে।"
Mily