
বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট ছয় দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে তুলেছেন এক অবিচল আর আর্থিকভাবে সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার। যদিও তিনি চলতি বছর বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সিইও পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, তবুও কোটি কোটি মানুষ এখনো তার দিকনির্দেশনার ওপর ভরসা রাখেন-বিশেষ করে কোথায় বিনিয়োগ করবেন আর কোথায় একদমই নয়।
আপনি যদি বিনিয়োগ শুরু করার কথা ভাবছেন, তাহলে তার এই সাবধানতাগুলোর পেছনের যুক্তিগুলো জানা জরুরি। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো এমন ছয়টি খাত, যেখানে বাফেট সচেতনভাবে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন, এবং কেন তা করেছেন।
১. প্রযুক্তি খাতের স্টার্টআপ
প্রযুক্তি খাত ও স্টার্টআপ কোম্পানি সম্পর্কে বরাবরই সংশয়ী ছিলেন বাফেট। অ্যামাজন, অ্যাপল বা ফেসবুকের মতো কোম্পানি এখন বিশ্বজুড়ে পরিচিত নাম হলেও, বছরের পর বছর তিনি এসব কোম্পানিকে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, এদের মূল্যে আকাশছোঁয়া ‘প্রাইস-টু-আর্নিংস রেশিও’ এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ছিল বেশি।
বাফেটের একটি জনপ্রিয় বিনিয়োগ নীতি হলো ‘Margin of Safety’, অর্থাৎ তিনি এমন জায়গায় বিনিয়োগ করেন যেখানে ক্ষতির ঝুঁকি কম। প্রযুক্তি খাতের অনেক কোম্পানি এই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।
তবে তিনি সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে রাখেননি। অ্যাপলের স্থিতিশীলতা প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি সেখানে বড় আকারে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ২০২৪ সালে তিনি অ্যাপলের শেয়ার থেকে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের অংশ বিক্রি করেন,যা প্রমাণ করে, তার সন্দেহ এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি।
২. টেসলা
বর্তমানে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা টেসলা বাফেটের নজরে কখনোই ছিল না। প্রযুক্তি খাতের মতোই, টেসলার শেয়ারদরের উঠানামা ছিল অত্যন্ত অনির্দেশ্য। তাছাড়া, বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল শিল্পে একটি কোম্পানির টিকে থাকা দীর্ঘমেয়াদে কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া, বাফেট কোম্পানির সিইওদের ব্যক্তিত্ব ও দায়িত্ববোধকেও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন। তার বিখ্যাত একটি উক্তি হলো, "একটি সুনাম গড়তে ২০ বছর লাগে, আর তা নষ্ট করতে লাগে মাত্র ৫ মিনিট।" এ দৃষ্টিকোণ থেকে, এলন মাস্কের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে তিনি কখনোই নিজের বিনিয়োগ দর্শনের সঙ্গে মেলাতে পারেননি।
৩. ক্রিপ্টোকারেন্সি
বাফেটের ক্রিপ্টোকারেন্সি এড়িয়ে চলা নতুন কোনো খবর নয়। ফেসবুক বা অন্য প্রযুক্তি কোম্পানির মতোই, যে জিনিসটি তিনি পুরোপুরি বোঝেন না, তাতে তিনি বিনিয়োগ করেন না।
তবে একবার তিনি সামান্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেন ব্রাজিলিয়ান কোম্পানি ‘Nu Holdings’-এ, যাদের একটি নিজস্ব ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। তবে এই বিনিয়োগ ছিল তার সামগ্রিক পোর্টফোলিওর তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
৪. জটিল ডেরিভেটিভস
বাফেট ডেরিভেটিভস থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেননি, তবে তিনি এটিকে ‘আর্থিক গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ বলে বর্ণনা করেছেন। ডেরিভেটিভস হলো এমন একটি জটিল আর্থিক চুক্তি, যার মূল্য নির্ভর করে অন্য কোনো সম্পদের (যেমন শেয়ার, বন্ড, সুদের হার কিংবা পণ্য) পারফরম্যান্সের ওপর।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকট এবং বেশ কিছু হেজ ফান্ডের ধসের পেছনে এই ডেরিভেটিভসই বড় ভূমিকা রেখেছিল। তাই বাফেটের এই খাত সম্পর্কে সংশয় যে অমূলক নয়, সেটি ইতিহাসই প্রমাণ করেছে।
৫. সোনা
সোনাকে বরাবরই ‘অপ্রোডাকটিভ অ্যাসেট’ হিসেবে দেখেছেন বাফেট। তার মতে, এটি উৎপাদন করে না, আয়ও দেয় না। যদিও ২০২০ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে স্বর্ণ ও তাম্রখনির খ্যাতনামা কোম্পানি ‘Barrick Gold’-এ বিনিয়োগ করেছিল, তবে সেটি সোনার ওপর নয়, বরং সোনাবিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ছিল।
৬. এয়ারলাইনস
বাফেটের একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ২০১৬ সালে ডেল্টা, আমেরিকান, সাউথওয়েস্ট এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে বিনিয়োগ করা। যদিও সেই সময় এই খাতটি লাভজনক মনে হয়েছিল, ২০২০ সালের কোভিড মহামারিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে এসব কোম্পানি। পরবর্তীতে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতিসহ এসব শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
বর্তমানে বিমান ভ্রমণ আবারও সচল হলেও, মাঝেমধ্যেই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার খবর ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি বাফেটকে এই খাত থেকে দূরে রেখেছে।
বিনিয়োগে ওয়ারেন বাফেটের সাফল্য তাকে ‘অর্থনীতির জাদুকর’ হিসেবে পরিচিতি দিলেও, তার ভুল সিদ্ধান্তগুলো থেকেও শেখার আছে অনেক কিছু। ট্রেন্ড নয়, বরং ধৈর্য, স্থিতিশীলতা এবং কোম্পানির প্রকৃত মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। বিনিয়োগ জগতে যারা নতুন, তাদের জন্য বাফেটের এসব সংযত সিদ্ধান্ত হতে পারে এক পরিপক্ব শিক্ষার পথ।
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা যখন ঝুঁকির সঙ্গে মুনাফার হিসাব কষে, তখন বাফেট প্রমাণ করেছেন সবচেয়ে বড় লাভ আসতে পারে যখন আপনি জানেন কোথায় বিনিয়োগ করবেন না।
সূত্র:https://tinyurl.com/bdcwmf4d
আফরোজা