
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনার গণ্ডি পেরিয়ে এবার ইরানের শাসনব্যবস্থার হৃদপিণ্ডে সরাসরি আঘাত হেনেছে ইসরায়েল। লক্ষ্য ছিল তেহরানের কুখ্যাত রাজনৈতিক বন্দি কারাগার ‘ইভিন’। বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিছক কোনো বোমা হামলা নয়—বরং ইরানি প্রশাসনের মূল স্তম্ভে সরাসরি বার্তা ছুড়ে দেওয়া এক পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সাআর হামলার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণের একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখেন, “Viva la libertad!”—স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক। ভিডিওতে দেখা যায়, প্রবল বিস্ফোরণে ইভিন কারাগারের একটি ভবন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। শুরুতে ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করতে না পারা গেলেও, পরবর্তীতে কারাগারে উদ্ধার তৎপরতার আরও কিছু ভিডিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম IRIB কারাগারের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আহতদের উদ্ধার করার দৃশ্য প্রচার করেছে।
উল্লেখ্য, ইভিন কারাগার বহু বছর ধরে ইরানের ভিন্নমতাবলম্বী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও বিদেশি নাগরিকদের আটক রাখার জন্য bername-প্রতিষ্ঠান। এখানে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর চালানো হয় নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত সাজা ও মৃত্যুদণ্ড। তাই এই কারাগার শুধু একটি বন্দিশিবির নয়—বরং সরকারের দমননীতির অন্যতম প্রতীক।
ইসরায়েল শুধু ইভিন কারাগারেই নয়, তেহরানে বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কমান্ড সেন্টার এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রেও একযোগে হামলা চালিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাফজ জানিয়েছেন, “আমরা এই মুহূর্তে তেহরানের কেন্দ্রস্থলে শাসনের দমনযন্ত্র ও প্রশাসনিক কাঠামোয় নজিরবিহীন আঘাত হানছি।”
এই একের পর এক হামলায় ইরানের রাজধানী আতঙ্কে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। তেহরানের প্রায় এক কোটি বাসিন্দার বড় অংশই শহর ছাড়তে শুরু করেছে। ইভিন এলাকায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার কারণে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অন্যদিকে, ইরান ক্ষোভে ফুঁসছে। দেশটির সামরিক সদর দপ্তর ‘খাতাম আল-আনবিয়া’র মুখপাত্র ইব্রাহিম জোলফাকারি ট্রাম্পকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ট্রাম্প সাহেব, আপনি হয়তো যুদ্ধ শুরু করতে পারেন, কিন্তু শেষ করবে আমরাই।” তবে এতসব হুমকির পরও ইরান এখনো বড় ধরনের কোনো পাল্টা আঘাত হানেনি।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও থেমে নেই। এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, “Regime Change কথাটা হয়তো রাজনৈতিকভাবে ঠিক নয়, কিন্তু যদি বর্তমান ইরানি সরকার ‘Make Iran Great Again’ না করতে পারে, তাহলে পরিবর্তন হতেই পারে! MIGA!!!”
বিশ্বব্যাপী এ হামলার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে। ইরানের সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মস্কোয় সাক্ষাৎ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে মরিয়া।
এদিকে, ইরানে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শারীরিক অবস্থা ও বয়স নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন জোর গুঞ্জন, তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে উঠে আসছেন দুই সম্ভাব্য নাম—পুত্র মোজতবা খামেনি ও খোমেনির নাতি হাসান খোমেনি। রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় কে হবেন শাসক, তা নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে পড়ছে ইরানের ক্ষমতাকেন্দ্র।
ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়—পুরো বিশ্বের জন্যই হবে নজরদারির বিষয়। বিশেষ করে তেল সরবরাহ নিয়ে তৈরি হতে পারে নতুন সংকট। যদিও ইরানের পক্ষ থেকে হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব উঠেছে, তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। অপরদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এটা করলে ইরান নিজের অর্থনীতির গলায় ছুরি চালাবে। আমাদেরও বিকল্প রয়েছে।”
তেলের বাজারে এই হামলার প্রভাব কিছুটা অনুভূত হলেও বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়নি। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কিছুটা বাড়লেও তা দ্রুত স্থিতিশীল হয়ে পড়ে, যা বোঝায়—বাজার এখনও বিশ্বাস করছে না ইরান বড় কিছু করবে।
পরিস্থিতি যত এগোচ্ছে, মনে হচ্ছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর চাপ বাড়িয়ে এক ধরনের 'Regime Collapse'-এর কৌশল নিচ্ছে। এর ফলাফল কেমন হবে, তা নির্ভর করছে তেহরানের পরবর্তী পদক্ষেপ ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার উপর।
Mily