ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

খুলনার ভৈরব সেতু ॥ জনভোগান্তি চরমে, বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী

দুইবার মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ হয়েছে ১৮ শতাংশ

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস

প্রকাশিত: ০১:২০, ২৪ জুন ২০২৫

দুইবার মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ হয়েছে ১৮ শতাংশ

দুই বছর মেয়াদের ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ কাজ ছয় বছরে পিলার ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নয়

প্রায় ৬১৮ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর। এরই মধ্যে দুইবারের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের জুনে। কিন্তু কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১৮.২০ শতাংশ। ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে খুলনার ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ কাজের।

চলাচলের সুবিধাসহ অর্থনীতির চাকা সচল করতে একটি ব-দ্বীপের সঙ্গে খুলনা শহরের সংযোগ স্থাপন প্রকল্পের এমন দশায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও নাগরিক নেতারা। সড়ক বিভাগের দাবি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতি। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানালেন জমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও নকশা পরিবর্তনের কারণে কাজে বিলম্ব হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এক দশমিক ৩১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও সোয়া ১০ মিটার প্রস্থের অত্যাধুনিক সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর। শেষ হওয়ার কথা ২২ সালের ২৫ নভেম্বরে। এরপর প্রথম মেয়াদ বাড়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২৬ সালের ৩০ জুন।

জমি অগ্রিহণসহ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু সেতু নির্মাণে ব্যয় ৩০২ কোটি ২৮ লাখ আর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে ২৮১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বাকি টাকা ব্যয় হবে অন্যান্য খাতে। মূল সেতুটি হবে নগরীর রেলিগেট থেকে দীঘলিয়ার নগরঘাট ফেরিঘাট পর্যন্ত। সেতুর সঙ্গে সড়কের সংযোগ ঘটাতে ফেরিঘাট থেকে নগরীর মহসীন মোড় এবং দীঘলিয়ার নগরঘাট থেকে উপজেলার মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার বা ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকার শহরের পাড়ে জায়গা নির্ধারণ ও কিছু স্থাপনা ভাঙচুরের দৃশ্য ছাড়া কিছুই চোখে পড়বে না। তবে দীঘলিয়ার পাড়ে সারি সারি বেশ কিছু পিলার তৈরি হয়েছে। তাও দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় মরিচা ধরেছে রডে, খসে পড়ছে পলেস্তারা। স্থানীয়রা জানায়, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা উন্মুক্ত এই ঘাটে ১০ থেকে ১২ হাজারের অধিক লোক প্রধানত পারাপার হন ট্রলারে।

রোদ কিংবা বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে উঠতে হয়। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিস্তার নেই। দুই চাকার যানবাহন উঠানো যেন রীতিমতো ঝক্কি। এরপর পড়ে যাওয়া কিংবা ট্রলার ডুবে যাওয়ার ভয় তো রয়েছেই। একটি মাত্র ফেরি চলে পরিবহনের সময় ধরে। সেখানেও মানুষ ও যানবাহনে ঠাসা থাকে। প্রতিদিন কয়েক’শ গাড়ি পার হয় এই ঘাটে। 
ভৈরব, আতাই ও চিত্রা নদী দ্বারা বেষ্টিত ব-দ্বীপ প্রধান দীঘলিয়া সদর, সেনহাটি ও বারাকপুর ইউনিয়নের প্রায় লাখ মানুষের জেলা বলি, বিভাগ বলি বা অন্য জেলার উপজেলাতে যেতে হবে কোনো না কোনো নদী পার হয়ে। 
হালিমা বেগম নামের এক সরকারি চাকরিজীবী বলেন, ছেলেমেয়ে স্কুল- কলেজে পড়ে, তাই খুলনা শহরে বাসা ভাড়া করে থাকি। সেতুটি না হওয়ায় প্রতিদিন দুইবার নদী পারাপার হতে হয়। যে কোনো দুর্যোগে পড়তে হয় বেকায়দায়। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থী, কৃষিপণ্য ক্রেতা-বিক্রেতা, শিশু, নারী ও বয়সীরা পড়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে। প্রায়ই নদীতে মানুষ ও যানবাহন পড়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা অসীম শেখ বলেন, এ সকল দুর্ভোগ লাঘবে চারদিকে নদীবেষ্টিত দীঘলিয়ার তিনটি ইউনিয়নকে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ শুরু হয় প্রায় ছয় বছর আগে। শুনতাম দুই বছরে শেষ হবে। এরপর পার হয়েছে আরও চার বছর। কিন্তু কয়েকটি পিলারের অংশ বিশেষ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। তাই এলাকাবাসীর দুঃখের ও কষ্ঠের শেষ নেই। 
প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করিম গ্রুপের ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এস এম নাজমুল বলেন, গতমাস পর্যন্ত কাজ হয়েছে ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ। জানালেন মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ মিটার। নদের মাঝের পিলার সরিয়ে স্টিলের অংশটুকু ১৬০ মিটারে বর্ধিতের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা এখনো অনুমোদন হয়নি। মূলত এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কাজ আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, জমি অধিগ্রহণের জটিলতায় প্রকল্পের শুরুতেই সময়ক্ষেপণ হয়েছে। রেলের জায়গার সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় দুই মেয়াদে ভালোভাবে কাজ করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আমরাও লোকসানের মুখে পড়েছি।
সড়ক ও জনপথ খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, আমরা বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি লিখছি কাজ করার জন্য। কিন্তু তারা যেন কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। আমরা তাদের বলার চেষ্টা করছি মূল সেতুর মাঝের যে ১০০ মিটারের পরিবর্তে ১৬০ মিটার করা হচ্ছে সেইটুকু বাদে বাকি কাজ করতে, কিন্তু তারা করছে না। বিষয়টি উচ্চ মহলে জানানো হয়েছে।

×