ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

পঞ্চগড়ের কাজলদীঘি: ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

মেহেদী হাসান সেতু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ০১:৫৭, ২৪ জুন ২০২৫

পঞ্চগড়ের কাজলদীঘি: ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

ছবি: সংগৃহীত

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত ‘কাজলদীঘি’ শুধু একটি সাধারণ জলাধার নয়, এটি ইতিহাস ও লোককাহিনির এক জীবন্ত স্মারক। পঞ্চগড় সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এ দীঘিটি এলাকাটির অন্যতম প্রাচীন ও পরিচিত জলাশয়।

প্রায় ১৭ একর জমির ওপর বিস্তৃত কাজলদীঘি উত্তর-দক্ষিণে কিছুটা লম্বাটে হলেও আয়তনে প্রায় বর্গাকার। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৫০ মিটার এবং প্রস্থে ২০০ মিটার এই দীঘির চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে ঘনবসতি। বর্তমানে প্রায় অর্ধশত পরিবার এই দীঘিকে কেন্দ্র করে তাদের জীবন-জীবিকা গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে স্থানীয় হাট-বাজার ও কবরস্থান। দীঘির চারপাশে ছায়া ঘেরা বৃক্ষরাজি, ফলদ গাছ, বাঁশঝাড় ও লেবুগাছ এলাকাটিকে করেছে নয়নাভিরাম।

দীঘির পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ‘কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’, যা শিক্ষা বিস্তারে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কিংবদন্তির ছায়ায় ‘কাজলদীঘি’র জন্ম

কাজলদীঘির নির্দিষ্ট খননকাল বা খননকারীর তথ্য ইতিহাসে নেই। তবে স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত এক হৃদয়স্পর্শী কিংবদন্তি দীঘিটিকে দিয়েছে আবেগময় ব্যাখ্যা।

লোককথা অনুসারে, একসময় এ অঞ্চলে এক রাজা ও তাঁর সাত রাণী বাস করতেন। দীর্ঘ নিঃসন্তান জীবনের পর এক সন্ন্যাসীর দেওয়া ফল খেয়ে ছোট রাণী এক অপূর্ব কন্যাসন্তানের জন্ম দেন এবং নাম রাখা হয় ‘কাজলিনী’। রাজ্যে বইতে থাকে আনন্দের ঢেউ।

কিন্তু হঠাৎই দেখা দেয় দীর্ঘ অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ। রাজা তখন বিশাল এক দীঘি খননের নির্দেশ দেন। তবে খনন শেষে তাতে পানি উঠতে চায় না। সন্ন্যাসীর পরামর্শে জানা যায়, জলদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে রাজকন্যা কাজলিনীকে পুজা দিতে হবে।

প্রজাদের উপস্থিতিতে রাজকন্যা স্বর্ণের থালায় পুজার সামগ্রী নিয়ে দীঘির মাঝখানে গিয়ে অর্ঘ্য দেন। মুহূর্তেই চারদিক গর্জে উঠে, দীঘি ভরে যায় পানিতে, তবে হারিয়ে যান রাজকন্যাও। কন্যার স্মৃতিতে রাজা এ দীঘির নাম রাখেন 'কাজলদীঘি'।

বিশ্বাস, কল্পনা ও কাব্য

স্থানীয়দের বিশ্বাস, পূর্ণিমার রাতে আজও কাজলদীঘির জলে দেখা যায় এক রুপার নৌকা, শোনা যায় নারীকণ্ঠের কান্না। দীঘির স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্বিত হয় প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য।

একাধিক সূত্র মতে, প্রখ্যাত কবি যথীন্দ্র মোহন বাগচি তাঁর জনপ্রিয় কবিতা “কাজলাদিদি” এই দীঘির পাড়েই রচনা করেছিলেন।

ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মিলনস্থল

প্রাচীন কিংবদন্তি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অপূর্ব সম্মিলনে ‘কাজলদীঘি’ হয়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার এক সম্ভাবনাময় ঐতিহাসিক ও পর্যটন কেন্দ্র। যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারণার মাধ্যমে এটি হতে পারে উত্তরবঙ্গের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

আসিফ

×