ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

কিশোরগঞ্জের হাওর কন্যা নিকলীতে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর 

আবু সালেহ মোঃ হামিদুল্লাহ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ২৬ জুন ২০২৫

কিশোরগঞ্জের হাওর কন্যা নিকলীতে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর 

বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলা হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দেশখ্যাত ও সমৃদ্ধময় হাওর অধ্যুষিত একটি অঞ্চল। এ জেলায় মোট ১৩টি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি উপজেলাই কোনো না কোনো প্রসিদ্ধ জিনিসের জন্য বিখ্যাত। ১৩ টি উপজেলার মধ্যে নিকলী উপজেলা হাওর অঞ্চলের জন্য বিখ্যাত। এটি অন্য উপজেলাগুলো থেকে অন্যতম স্থান দখল করে আছে তার অপরুপ সৌন্দর্যেঘেরা প্রাকৃতিক নিদর্শন হয়ে।

নিকলী হাওর কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। এর নাম এসেছে নিকলী উপজেলা থেকে। সেইসাথে নিকলী থেকেই এই হাওরটির উৎপত্তি হয়েছে। নিকলী ছাড়াও এই হাওরের পরিধি পার্শ্ববর্তী মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি রাজধানী ঢাকা থেকে ১১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি ও জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। ঢাকার সাথে সহজ সড়ক ও রেল যোগাযোগের কারণে এই হাওরের পর্যটন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নিকলীতে বর্তমানে একাধিক আবাসিক হোটেল গড়ে উঠায় পর্যটকরা এখন একাধিক দিন হাওর ভ্রমণের সুবিধা পাচ্ছে। বর্ষায় এই হাওর যখন পানি দ্বারা পূর্ণ হয় তখন ব্যাপক হারে পর্যটক বৃদ্ধি পায়।

এখন বর্ষাকাল তাই কিশোরগঞ্জের এই হাওরে বাড়ছে বর্ষার পানি। পানি বাড়ার সাথে সাথে নান্দনিক হয়ে ওঠছে হাওর জনপদ। সৌন্দর্যের বিপুল পসরা যেন হাওরের অঙ্গে অঙ্গে সাজানো। অপরূপা সৌন্দর্যে ঘেরা হাওরে এখন কেবল পর্যটকদের আনাগোনাই দৃশ্যমান। বর্ষার পানির আগমনে হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত আজ নিকলীর এই হাওর অঞ্চল।পর্যটকদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হওয়া কিশোরগঞ্জের হাওরের দ্বার এখন করিমগঞ্জের বালিখোলা হাওর। এরপরই শুরু হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি। রয়েছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের দীর্ঘ অলওয়েদার সড়ক। এছাড়া রয়েছে হাওররাণী খ্যাত পর্যটন এলাকা নিকলীর বেড়িবাঁধ।

সৌন্দর্য্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে ওঠেছে হাওরের মনোরম এসব স্থান। প্রতিবছরের ন্যায় এবারের বর্ষায় দেশের বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণ পিপাসুরা যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি দূর করতে দলে দলে ছুটে আসছেন প্রকৃতির লীলাভূমি উপভোগ করার জন্য।

এদিকে পর্যটন আকর্ষণের এ বিষয়টি মাথায় রেখেই পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এসব স্থানে নতুন করে গড়ে ওঠেছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট সহ নানা পর্যটন সেবা প্রতিষ্ঠান।

এখানে রয়েছে অলওয়েদার সড়ক যা সব ঋতুতেই ব্যবহার যোগ্য একটি অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সড়ক, এছাড়াও বালিখোলা হাওর ও নিকলীর বেড়িবাঁধ ছাড়াও হাওরে পর্যটকদের দেখার মতো বেশ কিছু মনোরম জায়গা রয়েছে।

মিঠামইনের প্রান্তসীমায় দিল্লীর আখড়া, অষ্টগ্রামের কুতুবশাহী মসজিদ, ইটনার শাহী মসজিদ, জয়সিদ্ধিতে র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর বাড়ি, ধনপুরের কাঠুইরে গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি, নিকলীর হাওর, ছাতিরচরের করচবন, ছেত্রার নারায়ন গোস্বামীর আখড়া, সুলতানী আমলের গুরুই মসজিদ, দ্বীপ আখড়া কানাই ভিটা, করিমগঞ্জ-মিঠামইনের হাওরে হাসানপুর সেতু, মরিচখালী হাওর, নিকলী-করিমগঞ্জ সড়ক, তাড়াইলের হিজলজানি হাওর ইত্যাদি স্থানে ভিড় জমাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকেরা।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাওরে ছুটছেন সৌন্দর্য্য আর ভ্রমণপিপাসুরা। বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ আর ঢেউয়ের গর্জন। বুকভরে হাওরের নির্মল বাতাস নেওয়ার প্রশান্তি সত্যিই অসাধারণ। ঠিক যেন সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটার দৃশ্যপট অবলোকন করার প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এখানে।

বালিখোলা ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে অনেকেই ছুটেন হাওর ভ্রমণে। নৌকাযোগে ছুটে যান অদূরের হাসানপুর ব্রীজে। সেখানে ফটোসেশন, আড্ডা আর ঘুরেফিরে সময় কাটানোর পাশাপাশি ব্রীজের সাবমার্চেবল সড়ক অংশে পা ভেজান হাওরের জলে।

বালিখোলা ও হাসানপুর ব্রীজ ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ। রয়েছে সংযোগ সড়ক। এসব বেড়িবাঁধ বা সড়কে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধ বা সড়কে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য।

প্রতিদিন সারাদেশ থেকে হাজারো দর্শণার্থী ছুটে আসছেন হাওরের নির্মল বাতাসে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার পাশাপাশি হাওরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য।

হাওরের নান্দনিক স্থানের মধ্যে দর্শনার্থীদের কাছে পছন্দের একটি নাম নিকলী বেড়িবাঁধ। নিকলী উপজেলা সদরে হাওরের ঢেউয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে ২০০০ সালে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে নিকলী উপজেলা পরিষদের সামনের প্রতিরক্ষা দেওয়াল বাঁধটিকেও বেড়িবাঁধ আকারে করে এর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই দীর্ঘ ৬ কিলোমিটারের এই হাওর রক্ষা বাঁধটিকে কেন্দ্র করে নিকলী পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

বর্ষা এলেই জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শণার্থীরা ছুটে যান নিকলীতে। এছাড়া নিকলী উপজেলা সদরের সাথে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকায় সেটিও দর্শণার্থীদের আগ্রহী করে তুলছে।

নিকলী বেড়িবাঁধ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোট ভাড়ায় নিয়ে দর্শণার্থীরা হাওরের মাঝে ভেসে বেড়ানোরও সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্য্য অবগাহনে হাজারো পর্যটক ভিড় জমান। বালিখোলা ঘাট, মিঠামইন বাজারের লঞ্চঘাট, নিকলী বেড়িবাঁধ ইত্যাদি পয়েন্টে স্পিডবোট, ট্রলার আর ইঞ্জিনচালিত নৌকার বহর লেগেই থাকে।

শত ব্যস্ততা ভুলে এখানে এসে মিলে যেন প্রাণের স্পন্দন। জীবনের নানা জটিলতা ও কষ্ট খানিকটা সময় ভুলে সবাই আনন্দে ভরিয়ে তুলেন নিজেদের। পর্যটকদের অনেকে মনে করেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এরকম একটি পর্যটন কেন্দ্রকে আরো সৌন্দর্য বর্ধনে ও আকর্ষণীয় করে তুলতে যথার্থ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দেশের অন্যতম একটি টুরিস্ট স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব সেইসাথে স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ দর্শনার্থীদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি থাকাখাওয়ার জন্য মানসম্মত হোটেল মোটেল ও ভালোমানের রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের‌ও দৃষ্টি পড়বে কিশোরগঞ্জের নিকলীর এই হাওর অঞ্চলের দৃশ্যপটে।

রাজু

×