
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
রাজশাহীর শহুরে ব্যস্ততার মাঝেও কিছু এলাকা আছে যেখানে সময় যেন থেমে আছে। তেমনই একটি এলাকা হলো কয়েরদাড়া খ্রিষ্টানপাড়া (কলিমনগর, সেন্ট লুইস পাড়া)। শহরের কেন্দ্র থেকে খুব একটা দূরে নয় এই পাড়া, অথচ এখানে ঢুকলেই মনে হয়, এক ধাক্কায় ফিরে গিয়েছি ১৯৯০ দশকে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় যেখানে শহরের প্রতিটি প্রান্ত বদলে গেছে, সেখানে এই পাড়াটি এখনও আগলে রেখেছে এক টুকরো শান্ত-সহজ জীবন।
প্রবেশমুখেই চোখে পড়ে সাজানো-গোছানো টিনের ঘর, দেয়ালে রঙিন ফুলের টব, আর উঠানে বসে থাকা বয়স্ক মানুষের দল—যারা আজও বিকেল হলে গল্পে মশগুল হন। পাড়ার গলিগুলো সরু হলেও পরিচ্ছন্ন। যেন প্রতিদিন কেউ না কেউ সময় দেন ঝাড়ু দিতে, গাছগুলোকে পানি দিতে। পরিবেশের এমন পরিচ্ছন্নতা এখন শহরের বিলাসিতার মতো।
এই পাড়ায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাস হলেও, দীর্ঘদিন ধরেই মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে চমৎকার এক সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বড়দিন হোক কিংবা ঈদ, পাড়ার মানুষ একে অপরের বাড়িতে যান, শুভেচ্ছা দেন, খাবার ভাগাভাগি করেন। চার্চের ঘণ্টাধ্বনি আর পাশের মসজিদের আজান এখানে কখনো দ্বন্দ্ব তৈরি করেনি; বরং সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব সহাবস্থানের নজির।
সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পাড়া পিছিয়ে নেই। প্রতি বছর বড়দিন, নববর্ষ, বা স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় নাটক, গান, কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। এখানকার তরুণরা নিজেরাই আয়োজন করে সবকিছু, আবার নিজেরাই অভিনয় করে, গান গায়। শিশুদের জন্যও নানা ধরনের প্রতিযোগিতা হয়।
তরুণ সমাজ এখানে এখনও সামাজিক কাজে সরব। কেউ অসুস্থ হলে আগে খবর যায় পাড়ায়, তারপরে হাসপাতালে। কেউ বিপদে পড়লে প্রতিবেশীরাই আগে পাশে দাঁড়ান। বয়স্কদের দেখভাল, পথচারী বৃদ্ধদের সাহায্য—সব কিছুতেই এখনো মানবিক মূল্যবোধই মুখ্য।
তবে কিছু সমস্যা এখনও মাথাচাড়া দিয়ে আছে। অনেক ঘরেই বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কোনোটির টিন উঠে গেছে, কোথাও দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটও নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে। এসব নিয়ে স্থানীয়রা বহুবার অভিযোগ করলেও সাড়া মেলেনি বলেই অভিযোগ তাদের।
এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মার্টিন সবুজ হাঁসদা বলেন, "আমরা ছোটবেলায় যেমন পাড়ায় মিলেমিশে বড় হয়েছি, এখনও তা-ই চলছে। বড়দিনে যেমন সবাই আসে আমাদের বাড়িতে, ঈদেও আমরা যাই তাদের বাসায়। খেলা হোক বা কষ্ট—সব কিছু আমরা ভাগাভাগি করে নেই। টিভি বাইরে বের করে খেলা দেখা আমাদের একটা পুরোনো অভ্যাস, যাতে সবাই একসাথে আনন্দ করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "অনেক সময় সমস্যাও হয়, যেমন বিদ্যুৎ থাকে না, ড্রেনেজ ঠিকঠাক নয়। কিন্তু সম্পর্কগুলা এখনও ঠিক আগের মতোই। এইটাই আসল শক্তি।"
তবুও জীবন চলে নিজের গতিতে। শহরের কোলাহলের ভেতরেও কয়েরদাড়া খ্রিষ্টানপাড়া টিকে আছে তার সরলতা, আন্তরিকতা আর আত্মিক বন্ধনের মাধ্যমে।
৯০ দশকে যে মানবিকতা, সামাজিকতা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে চিত্র দেখা যেত, তা এখন প্রায় হারিয়েই গেছে আধুনিক শহরে। কিন্তু এই একটি পাড়া সেই চিত্রকে এখনও আগলে রেখেছে নিঃশব্দে। কয়েরদাড়া খ্রিষ্টানপাড়া যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—উন্নয়ন শুধু ভবন আর রাস্তা দিয়ে নয়, মানুষের ভেতরের মানসিকতা আর বন্ধনের মাধ্যমেও।
এটা শুধু একটি পাড়া নয়—এটা সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এক নীরব সাক্ষী, যেখানে মানুষ এখনো মানুষ হয়ে আছে।
মিরাজ খান