
ছবি: সংগৃহীত
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে যিনি ইরানকে পরিচালনা করছেন, তিনি শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক নন—আয়াতুল্লাহ আলী হোসেনী খামেনেয়ী হলেন একাধারে একজন ফকীহ, মুজতাহিদ, চিন্তক এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রবক্তা। তাঁর পরিচয়ের গভীরে রয়েছে এক ঐতিহাসিক বংশধারা—নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর ঘরানা, কাশ্মীরি শেকড় এবং ইরানী ধর্ম-রাজনীতির শিখর ছোঁয়ার গল্প।
জন্ম ও পারিবারিক শিকড়
১৭ জুলাই ১৯৩৯ সালে খামেনেয়ী জন্মগ্রহণ করেন ইরানের ধর্মীয় নগরী মাশহাদে। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ জাওয়াদ খামেনেয়ী ছিলেন একজন শ্রদ্ধেয় আলেম, যিনি সাধনামূলক দারিদ্র্য জীবন বেছে নিয়েও ধর্মীয় প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন।
“সৈয়দ” উপাধি এবং তাঁর পরিধান করা কালো পাগড়ি নির্দেশ করে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশধর, বিশেষত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর উত্তরসূরি। ইরানের শিয়া সংস্কৃতিতে কালো পাগড়ি শুধু নবী-পরিবারের লোকদের জন্য সংরক্ষিত একটি ঐতিহ্য।
গবেষণা অনুযায়ী, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর পূর্বপুরুষরা ভারতীয় উপমহাদেশের কাশ্মীর অঞ্চল থেকে ১৮শ বা ১৯শ শতকে ইরানে হিজরত করেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা, ফিকাহশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে পরিত্রাণের আশায় বহু সৈয়দ পরিবার সে সময় ইরান ও ইরাকে পাড়ি জমায়।
শিক্ষা ও ইসলামি চিন্তাধারা
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কোম ও নাজাফের হাওযা ইলমিয়াতে ইসলামী আইন, কুরআনিক দর্শন ও রাজনীতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ইমাম খোমেনির (রহ.) ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেনির ইন্তেকালের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা (Supreme Leader) নিযুক্ত হন।
শিয়া-সুন্নি ঐক্যের পথিকৃৎ
শুধু রাষ্ট্র পরিচালনাই নয়, খামেনেয়ী শিয়া মাজহাবে কিছু বিতর্কিত রীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি একাধিকবার ফতোয়া দিয়ে শিয়া-সুন্নি ঐক্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হলো:
সাহাবিদের গালি দেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা
মহররমে আত্মপীড়নমূলক আচরণ (যেমন রক্ত ঝরানো) নিরুৎসাহিত
শিয়া-সুন্নি মুসল্লিদের একসঙ্গে মসজিদে নামাজ আদায়ে উৎসাহ
কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক যৌথ গবেষণাকে অগ্রাধিকার
ক্ষমতা ও ব্যক্তিজীবন
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামোতে তিনি সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি—নিরাপত্তা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি পররাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে চলে। তবু ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রচারবিমুখ, বিনয়ী, আত্মনিবেদিত ও সাহিত্যপ্রেমী।
তিনি নিজে ফার্সিতে কবিতা লেখেন, সুফি কবি হাফিজ ও ইকবাল লাহোরির কবিতার অনুরাগী। তাঁর বক্তৃতায় পাওয়া যায় ইসলামী রেনেসাঁর ধারা ও বিশ্বমুসলিমের জাগরণের আহ্বান।
ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর জীবনবৃত্ত কেবল ইরানের নয়—সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্যই এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কাশ্মীর থেকে ইরানে তাঁর বংশধারার যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাস কিভাবে পরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তোলে। তাঁর অবস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে শুধুই তেহরানের নয়, বরং মদিনা, কুফা, নাজাফ, দিল্লি ও কাশ্মীরের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার এক যোগসূত্র।
তিনি যেন নবীজি (সা.)-এর বংশধর হয়ে আধুনিক বিশ্বে একটি “মুসলিম আত্মপরিচয়” নির্মাণের সাধক, যেখানে আছে ধর্মীয় শুদ্ধতা, রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং আন্তর্জাতিক ঐক্যের দৃঢ় বার্তা।
শেষ কথা
আজকের আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী কেবল একজন শাসক নন, বরং এক চলমান ইতিহাসের অংশ—যিনি নবী পরিবারের আলোকে নেতৃত্ব, ঐক্য ও আত্মসচেতনতায় মুসলিম বিশ্বের জন্য এক অবিচল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন।
শিহাব