
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি নীরব জনপদে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন সেতু, যা শুধু দুটি উপজেলার মধ্যকার সংযোগই নয়—এটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নীরব সাক্ষী। এই ঐতিহাসিক শুভপুর সেতু, যা ফেনী ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একাধিক রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে।
১৯৫২ সালে গড়ে ওঠা শুভপুর সেতু: উপমহাদেশ বিভাজনের পর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালে ফেনী নদীর ওপর নির্মাণ করে ৩৭৪ মিটার দীর্ঘ শুভপুর সেতু। ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত এই সেতু পরবর্তী ৬৯ বছর ধরে দুই অঞ্চলের অর্থনীতি, ব্যবসা ও যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এক রণাঙ্গন: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুভপুর সেতু হয়ে ওঠে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র। করেরহাট ইউনিয়নের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম ইসমাঈল মিন্টু মিয়া, সেক্টর-১ এর সাবসেক্টর কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু, শাহ্ আলম চৌধুরী ও মিহির চৌধুরীরা স্থানীয় সংগ্রামীদের একত্রিত করে কৌশল নির্ধারণ করেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল কুমিল্লা সেনা ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা।
মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও শহীদদের আত্মত্যাগ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার—বিশেষ করে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বর মাসে—শুভপুর ব্রিজকে ঘিরে খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাক বাহিনী এক পর্যায়ে ব্রিজের মাত্র ৪০০ গজের মধ্যে ঢুকে পড়ে। অস্ত্রের সংকটে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং অনেকে বীরত্বের সঙ্গে শহীদ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই মুহূর্তগুলো আজও কাঁপিয়ে তোলে এলাকার প্রবীণ মানুষদের হৃদয়।
ব্রিজে বিস্ফোরণ ও প্রতিরোধ: পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রগতি ঠেকাতে ব্রিজের ১০ নম্বর পিলারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে মুক্তিবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর শুভপুর ব্রিজ দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের সেই সময় থেকে আজও ব্রিজের শরীরে বিদ্ধ রয়েছে বুলেট ও কামানের ক্ষতচিহ্ন—যা মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত প্রমাণ।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময় ও মেরামত ইতিহাস: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোলাবর্ষণে সেতুটি বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধোত্তর সময়ে একাধিকবার সেতুটি মেরামত করা হলেও তা পূর্ণ পুনর্নির্মাণ হয়নি। ফলে এখনো ভারি ও মাঝারি যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। একদিকে এটি ব্যবহারে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শঙ্কা, অন্যদিকে ইতিহাসের মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সিনেমা ও টেলিভিশনে শুভপুর ব্রিজ: শুভপুর সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সৌন্দর্য এতটাই গভীর যে, ১৯৮০’র দশকে সরকারি অর্থায়নে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় ‘কলমি লতা’ নামে একটি ছায়াছবি। ১৯৯৬ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে নির্মিত একটি যুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্রও বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ব্রিজের দৃশ্যপট ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন বাংলা সিনেমার শুটিং স্পট হিসেবেও।
সংরক্ষণের জোর দাবি:
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, শুভপুর ব্রিজ শুধু একটি অবকাঠামো নয়—এটি একটি জাতীয় স্মারক। সরকারের প্রতি তাদের জোরালো দাবি, সেতুটিকে যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ করতে হবে। শুধু মাত্র যানবাহন চলাচলের জন্য নয়, নতুন প্রজন্মের ইতিহাস চর্চার স্থান হিসেবেও এই ব্রিজের ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে।
শুভপুর সেতু ইতিহাসের কণ্ঠস্বর হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই সেতু নীরবে স্মরণ করিয়ে দেয় শহীদের আত্মত্যাগ, যুদ্ধের গৌরব, এবং একটি জাতির জাগরণ।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন শুভপুর ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে এই দেশের বুকজুড়ে।
মিরাজ খান