ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ, রাজশাহীতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ০১:০৪, ৩০ জুন ২০২৫

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ, রাজশাহীতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ

ছবি: সংগৃহীত।

আজ সোমবার (৩০ জুন) ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ‘সিধু-কানু’ দিবস। রাজশাহী অঞ্চলে ‘সাঁওতাল হুল’ দিবস হিসেবেও দিবসটি পালন করা হয়। মুক্তিকামী সাঁওতালদের কাছে আজকের দিনটি এক মহান অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

১৭০ বছর ধরে দিবসটি সাঁওতালদের কাছে দাবি আদায়ের গৌরবোজ্জ্বল দিন হলেও শোষণ আর বঞ্চনার শিকার এখনো তারা। এখনো ফিরে পায়নি তারা ভূমির অধিকার। বিশেষ করে সমতলের সাঁওতালরা তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতিটা পায়নি আজও। নানা বঞ্চনার মধ্যেও দিবসটি উপলক্ষে এবারো রাজশাহী অঞ্চলে  নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও বিভিন্ন সাঁওতাল সংগঠন।

দিবসটি উপলক্ষে আজ সোমবার রাজশাহী নগরীতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গনেস মারান্ডি ও সাধারণ সম্পদিক বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় জানান, প্রতিবারের মত এবারো নিজস্ব স্বকীয়তায় তারা দিবসটি পালন করবেন রাজশাহীতে। এছাড়া পরিষদের বিভিন্ন ইউনিট দেশের বিভিন্ন এলাকায় এদিন মহান নেতা সিধু ও কানুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, নাচ, গান ও আলোচনার মধ্যে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাজশাহী নগরীর আলু পট্টি এলাকা থেকে বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করা হবে। এছাড়া আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের জোরালো দাবি জানানো হবে।

দিবসটি উপলক্ষে রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীর পরিচালক হরেন্দ্র নাথ সিং জানান, এবারের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক।

এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালদের নিয়ে গঠিত, রক্ষাগোলা গ্রামসমাজ সংগঠনের উদ্যোগে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাটে নানা কর্মসূচি পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ‘যেখানে অধিকার বঞ্চনা সেখানেই ‘হুল’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালন করা হবে।

প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে আজ থেকে ১৬৯ বছর আগে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটি ছিল প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই সিধু মুরমু ও কানু মুরমু স্মরণে ও শ্রদ্ধায় সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে সিধু-কানু দিবস বলে থাকেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত জমিদার, সুদখোর, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী, দারোগা-পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব, এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ান সাঁওতালরা। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই বোন ফুলোমনি মুরমু ও ঝালোমনি মুরমু।

ভারতের ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দামিন-ই-কোহ্ বা ‘পাহাড়ের ওড়না’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ভাগলপুরের ভগনা ডিহি গ্রামের সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চলে সংঘটিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভগনা ডিহি গ্রামে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত হয়। এই জমায়েতে সিধু-কানু ভাষণ দেন। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, অত্যাচারী শোষকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে। এখন থেকে কেউ জমির কোনো খাজনা দেবেন না এবং প্রত্যেকেরই যত খুশি জমি চাষ করার স্বাধীনতা থাকবে। আর সাঁওতালদের সব ঋণ এখন বাতিল হবে। তাঁরা মুলুক দখল করে নিজেদের সরকার কায়েম করবেন।

সেদিন ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছিলেন। ভগনা ডিহি গ্রামের ওই সভার শপথ ছিল বিদ্রোহের শপথ। বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও জুলুম থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির সঙ্গে উৎপাদনের কাজ ও জীবন ধারণ করার সংকল্প নিয়ে সাঁওতাল কৃষকেরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ান। তাঁদের এ বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দেন এলাকার শোষিত, বঞ্চিত বাঙালি ও বিহারি হিন্দু-মুসলমান গরিব কৃষক এবং কারিগরেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সব সম্প্রদায়ের গরিব জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করায় ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক বন্দুক ও কামানের কাছে টিকতে পারেনি। এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা মারা গিয়েছিলো। বিদ্রোহে পর্যায়ক্রমে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব নিহত হলে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রতিবছর এই দিনে তাই সিধু-কানুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ শ্রদ্ধাভরে দিবসটি পালন করে। এবারো নানা আনুষ্ঠানিকতায় রাজশাহী অঞ্চলে উদ্‌যাপন হবে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।

মিরাজ খান

×