
অচলাবস্থার কবলে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দু’দিন ধরে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির জেরে নজিরবিহীন স্থবিরতা নেমে এসেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও চট্টগ্রাম বন্দরে। সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। এর ফলে এই দুই সংস্থায় রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন না হওয়ায় বন্দর থেকে কন্টেইনার ডেলিভারি হচ্ছে না। তাই কন্টেইনারজটের শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় চরম সংকটের মুখে পড়েছে রপ্তানিমুখী পোশাক খাত। শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
চট্টগ্রাম বন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাস্টম হাউসে শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে পণ্য বের হচ্ছে না। আইসিডিগুলোতে কাজ না হওয়ায় বন্দরে আসতে পারছে না রপ্তানির কন্টেইনার। আমদানি পণ্যের ডেলিভারি এবং রপ্তানি পণ্যের জাহাজীকরণ দুটিই বন্ধ। শুধু তাই নয়, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শাটডাউনে থাকায় বাংলাদেশের জলসীমায় আসা জাহাজগুলোর নিবন্ধনও থেমে আছে। অপেক্ষমাণ জাহাজের সারিও ক্রমেই বাড়ছে।
রবিবার সকালে বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেইনারের সংখ্যা ৪০ হাজার টিইইউএস ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে। ইয়ার্ডের কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার টিইইউএস। কাজ আরও কয়েকদিন বন্ধ থাকলে কন্টেইনার বেড়ে ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। বড় আরেকটি সমস্যা হলো বেসরকারি আইসিডিগুলোতে শুল্কায়ন কাজ না হওয়ায় রপ্তানির কন্টেইনারগুলোর জাহাজীকরণ হচ্ছে না। সময়মতো কন্টেইনার এসে পৌঁছাতে না পারায় শনিবার ছাড়তে পারেনি তিনটি জাহাজ। এ জাহাজগুলোতে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার কন্টেইনার ওঠার কথা ছিল। রবিবারও একই অবস্থা।
বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার সচিব রুহুল আমিন শিকদার জনকণ্ঠকে জানান, ২১টি ডিপোতে রবিবার কন্টেইনার ছিল ৮২ হাজার একক। সাধারণত ৭৬ থেকে ৭৭ হাজার কন্টেইনার থাকে। কাস্টমস সংশ্লিষ্ট কাজ বন্ধ থাকায় পণ্যগুলো ডিপোতে পড়ে আছে। এতদিন দিবসের একটি নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা কর্মবিরতি চলে আসছিল। ফলে কার্যক্রমে ধীরগতি থাকলেও চলছিল। কিন্তু কাস্টমসে শাটডাউনে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন জানান, রপ্তানি পণ্যের জাহাজীকরণ পুরোপুরি বন্ধ দুদিন ধরে। এ অচলাবস্থার অবসান কবে, কীভাবে হবে তা অনিশ্চিত। এর ফলে ডিপোগুলোতে পণ্যের চাপ বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের মালিকরা।
একাধিক পোশাক শিল্প মালিক জানান, তাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো যাবে না। সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয় হলো অনিশ্চয়তা। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছবে তা জানা না থাকায় ক্রেতাদেরও কোনো ধরনের আশ^াস বা ম্যাসেজ দেওয়া যাচ্ছে না। পোশাক শিল্পখাত একই সঙ্গে পড়েছে আমদানির পণ্য হাতে না পাওয়ার সংকটে। বিদেশ থেকে আসা এ পণ্যগুলো শিল্পের কাঁচামাল। বন্দরে চলে আসা পণ্য তারা খালাস নিতে পারছেন না। এতে উৎপাদনও মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি উভয় খাত।
শাটডাউনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে শিপিং সেক্টরেও। কারণ জাহাজ ভেড়াতে এবং ছেড়ে যেতে প্রয়োজন হয় অনুমতি। কাস্টমসে কাজ বন্ধের কারণে জাহাজগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রম থমকে গেছে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে বিদেশি মাদার শিপিং কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ। রবিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে তিনি জানান, এনবিআরে শাটডাউন কর্মসূচিতে কার্যত ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড শাটডাউন হয়ে গেছে। রপ্তানি পণ্যের গন্তব্যে পৌঁছা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ছাড়করণ এবং উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি দুটিই বন্ধ।
অতীতে বিভিন্ন সময় বন্দরে কিছু শ্রমিক অসন্তোষ হলেও এই পরিস্থিতি নজিরবিহীন। বন্দর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমকে জরুরি সেবার আওতায় আনা যায় কি না তা বিবেচনার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন শিপিং সেক্টরের এই নেতা।
প্রসঙ্গত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুইটি বিভাগ গঠনের একটি অধ্যাদেশ জারি হয় গত ১২ মে। এতে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। প্রথমে ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও দাবি উত্থাপন। সেই আন্দোলন ক্রমেই কঠোরতার দিকে গড়ায়। গত শনিবার শুরু হয় কমপ্লিট শাটডাউন।
এতে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি, যা দেশের শিল্প এবং বাণিজ্য খাতকে এক প্রকারের অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। একক বৃহত্তম রাজস্ব যোগানদাতা সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কাজ বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরেও, যে বন্দর দিয়ে দেশের ৯০ ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।