ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

উপনিবেশ থেকে উৎসব পর্যন্ত খ্রিস্টান খাসিয়াদের জীবনরেখা

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ৩০ জুন ২০২৫

উপনিবেশ থেকে উৎসব পর্যন্ত খ্রিস্টান খাসিয়াদের জীবনরেখা

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার পাহাড়ি সবুজে ঘেরা নিরালা খাসিয়া পুঞ্জি যেন এক অন্যরকম বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উঁচুতে এই গ্রাম ছড়িয়ে আছে আঁকাবাঁকা মাটির পথ, উঁচু বাঁশ-লাকড়ির ঘর আর চারপাশে গহিন চা-বাগানের সবুজে মিশে থাকা খাসিয়া জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জীবনে।

এই সবুজ পাহাড়ি গ্রামকে এক সুতোয় গেঁথেছে তিনটি খ্রিস্টান চার্চ। উপাসনার গণ্ডি পেরিয়ে চার্চগুলো হয়ে উঠেছে পুরো সমাজের চালচলন, শিক্ষা আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

নিরালার তিনটি বড় গির্জা—ক্যাথলিক চার্চ, প্রেসবিটারিয়ান চার্চ আর চার্চ অফ গড—তিন রকম রঙ ছড়ায় এই পাহাড়ি সমাজে।

সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক চার্চ যেন গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। প্রায় ৯০টি পরিবারের ৬০০ জন খাসিয়া খ্রিস্টান এই চার্চের ছায়াতলে। মিশনারি পাদ্রী আর সিস্টাররা এখানে নিয়মিত আসেন—শুধু প্রার্থনা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর ন্যায়বিচার নিয়েও কথা বলেন। বড়দিন এলে এই চার্চ বদলে যায় রঙিন আলোর ঝলকানিতে। কাগজের ফেস্টুন, শিশুদের যিশুর জন্মের নাটক, খাসিয়া ভাষা আর বাংলা গানের এক অপূর্ব মিশেল—সব মিলিয়ে উৎসব যেন পাহাড় ছুঁয়ে যায়।

প্রেসবিটারিয়ান চার্চও কম নয়। প্রায় ৬০টি পরিবার, ৩২৫ জনের মতো খাসিয়া সদস্য। প্রতি রবিবার সকালে এখানে খাসিয়া ভাষা আর বাংলায় মিশ্রিত প্রার্থনা হয়। ছোটদের জন্য বাইবেল শিক্ষা আর ধর্মীয় গানের ক্লাস চলে। এখানকার সাপ্তাহিক প্রার্থনা যেন শুধু ধর্মীয় আচার নয়—সমাজের এক বন্ধন।

সবচেয়ে ছোট চার্চ অফ গড—যেন সরলতা আর আপনভোলার প্রতীক। ১৫টি পরিবার, প্রায় ৯০ জন খ্রিস্টান সদস্য। এখানে বাইরের গায়কদল নেই—নিজেরাই গান করেন, প্রার্থনা করেন। উৎসবও হয় ঘরোয়া, আন্তরিক।

এই চার্চগুলো শুধু উপাসনা নয়, খাসিয়া সমাজের প্রতিটি বাঁকেই জড়িয়ে আছে। বিয়ে পড়ানো থেকে মৃত্যু পরবর্তী সমবেদনা সভা—চার্চ ছাড়া কিছুই সম্পূর্ণ হয় না। সমবায় গঠন, স্বাস্থ্য সচেতনতা, শিক্ষা—সবকিছুতে চার্চের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো।

পাহাড়ি এই গ্রাম খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য বয়ে চলেছে। মেয়েদের নামে সম্পত্তি, ছেলেরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থাকা—সব কিছুতেই টিকে আছে শত বছরের রীতি। ঘরগুলো বাঁশ-লাকড়ি আর টিনে উঁচু করে বানানো—যেন বর্ষার বৃষ্টিতে পাহাড়ের কাদার স্রোতও ঢুকতে না পারে।

অর্থনীতির প্রাণশক্তি পান চাষ। প্রায় প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব পানবাগান আছে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গ্রামের মানুষ সাইকেল বা পায়ে হেঁটে নেমে যান বাজারে, বেচেন এই সবুজ সোনালী ফসল।

বড়দিন বা ইস্টার এলে নিরালা পুঞ্জি যেন আলোয় আর গানে জেগে ওঠে। তিনটি চার্চে চলে আলোকসজ্জা, খ্রিস্টান গানের আসর, শিশুদের যিশুর জন্মের নাটক। আর শেষে সবাই মিলে ভাত, মুরগি, স্থানীয় শাকপাতা, কখনো বিশেষ কেক—সবাই একসাথে ভাগ করে খায়।

নিরালা খাসিয়া পুঞ্জি এটি বাংলাদেশের পাহাড়ি খ্রিস্টান খাসিয়া সমাজের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনটি চার্চ এখানে শুধু প্রার্থনার জায়গা নয়—একটি সামাজিক কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা আর সহমর্মিতা মিলেমিশে এক হয়ে আছে পাহাড়ের সবুজ বুকজুড়ে।

Jahan

×