
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষের জীবনযাত্রা আজ বহুমাত্রিক সংকটের মুখোমুখি। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ ও সংঘাত, অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি এবং নৈতিক অবক্ষয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ এবং পানির অভাব মানুষের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ফেলছে। মানবজাতি যে গভীর অস্থিরতায় পতিত হয়েছে, তার পেছনে কেবল বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা নয়—ইসলামও এর একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশ করে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,স্থল ও জলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মানুষের কৃতকর্মের দরুন, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু ফল আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।(সূরা আর-রূম, আয়াত ৪১)। এই আয়াতে পৃথিবীর সব ধরনের বিপর্যয়ের উৎস হিসেবে মানুষের সীমালঙ্ঘন ও পাপাচারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষ আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করলে প্রকৃতিও তার প্রতিক্রিয়া দেখায়।
বর্তমান সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটছে তা ইসলামের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটি পূর্ব থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদিসে বলেছেন, যখন কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তা প্রকাশ্যে সংঘটিত হতে থাকে, তখন এমন রোগ ও মহামারি দেখা দেয়, যা পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে ছিল না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪০১৯)। এ হাদিসের আলোকে বলা যায়, আজকের নৈতিক স্খলন এবং সমাজব্যবস্থার পতনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যেও ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বে চলমান যুদ্ধ, দখল, নিপীড়ন এবং অসহায় মানুষের রক্তপাত ইসলামের ভাষায় ‘ফিতনা’র অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,কিয়ামতের আগে এমন ফিতনার যুগ আসবে, যেখানে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলা হবে। বিশ্বাসীকে অবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী মনে করা হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৯০৮)। বর্তমান বিশ্বের মিডিয়া বিভ্রান্তি, সত্যকে গোপন করা, জুলুমকে ন্যায়ের মোড়কে উপস্থাপন করা, এসবই সেই ফিতনার চিত্র।
একইভাবে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরা এসবও কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং মানুষের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা ও পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন,আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি এবং ফল-ফসলের ঘাটতির মাধ্যমে; আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৫৫)। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দুর্যোগ ও সংকট কেবল শাস্তি নয়, বরং তা ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য যাচাইয়ের একটি মাধ্যম।
তবে ইসলাম কখনো মানুষকে হতাশ করে না। বরং এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। আল্লাহ বলেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। (সূরা আর-রাদ, আয়াত ১১)। অর্থাৎ, সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব যদি মানুষ নিজেদের ভুল স্বীকার করে তাওবা করে, অন্যায়-অবিচার পরিহার করে এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ইসলামের দৃষ্টিতে এক গভীর বার্তা বহন করে। এটি কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক বিপর্যয়, যার উত্তরণ সম্ভব আত্মশুদ্ধি, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। পৃথিবীর শান্তি, মানুষের মুক্তি এবং পরকালের সফলতা একমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত পথেই নিহিত।
মিরাজ খান