
ছবি: জনকণ্ঠ
সার্কাসের ইতিহাস বেশ পুরনো, যার শুরুটা হয় ১৭৬৮ সালে ইংল্যান্ডের ফিলিপ অ্যাস্টলির হাত ধরে। তিনি ঘোড়ার খেলা দেখিয়ে প্রথম আধুনিক সার্কাস অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি করেন। পরবর্তীতে, এই ধারণা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে সার্কাস বিকশিত হয়।
বাংলায় সার্কাসের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে, ১৮৮৭ সালে প্রিয়নাথ বসু ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলা, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করে।
‘সার্কাস’ শব্দটির উদ্ভব ‘সার্কেল’ শব্দ থেকে। সার্কাসের প্রকৃত অর্থ হলো গোলাকৃতি লাইনের ওপর দিয়ে ঘোরা। প্রাচীন গ্রিসে লোহার তৈরি গোলাকৃতি লাইনের ওপর ঘুরতে ঘুরতে মূলত ঘোড়ারা প্রদর্শন করত বিভিন্ন ধরনের খেলা। আর সেখান থেকেই রচিত হয়েছিল বিশ্ব সার্কাস ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়।
পরবর্তীতে ঘোড়ার সঙ্গে যুক্ত হলো দু’চাকার ছোট্ট গাড়ি, হাতি, বাঘ, সিংহের মতো বন্য জন্তু-জানোয়ার। এমনকি মানুষও যুক্ত হলো এই প্রাচীন খেলায়। বন্য পশু এবং মানুষের শারীরিক কসরতযুক্ত এই খেলারই আরেক নাম হয়ে উঠল ‘সার্কাস’।
গ্রিসের পর সার্কাসের ইতিহাসে দ্বিতীয় যে দেশের নাম উঠে আসে, তা হলো রোম। তবে এই দুটি দেশ থেকে সার্কাসের উদ্ভব হলেও, পরে এটি গ্রিস-রোমের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমের অন্যান্য দেশে।
পশ্চিমে সার্কাস ট্রেন চালু করে সার্কাসের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন ইংল্যান্ডের উইলিয়াম ক্যামেরন। ক্রমে ছোট-বড় সবার মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে সার্কাস।
১৮৭৯ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম প্রবেশ করে একটি রোমান সার্কাস দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন উইলিয়াম সিরিন। পৃথিবীর অনেক দেশেই তখন এই দলটির সুনাম ছিল। ভারতে এসে তিনি ভারতীয়দের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে, এমন খেলা আর কেউ দেখাতে পারবে না।
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম বাজি জিতলেন তৎকালীন মারাঠা সম্রাট কুরুওয়ানদান। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রথম সার্কাস দল। মহারাষ্ট্র, কেরালা ছাড়াও বাংলাও হয়ে ওঠে সার্কাসের অন্যতম পীঠস্থান।
ইংরেজ আমলেও কলকাতাকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতি শীতেই তাঁবু খাটিয়ে বন্য জন্তু-জানোয়ারদের নিয়ে খেলা দেখাতে আসত বিভিন্ন সার্কাস দল। সেই সময় থেকেই কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে নিয়ম করে দেখানো হতো রাশিয়ান সার্কাস। এই জায়গার নামকরণও ওই সার্কাস প্রদর্শনের সূত্র ধরেই।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক পর্যন্তও প্রতি শীতেই জমজমাট থাকত পার্ক সার্কাস ময়দান। কখনও হাফপ্যান্ট পরে ক্রিকেট খেলছে বা শুঁড় উঁচিয়ে গণেশের মাথায় জল ঢালছে হাতি, কখনও চোখের ইশারায় ভয়ে ভেজা বিড়াল হয়ে উঠছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! কখনও মুখ বাঁকিয়ে রডে ঝুলে ক্যারিকেচার করছে মুখপোড়া বাঁদর, কখনও বা পাকা পাকা কথা বলে রিঙে ঝুলছে কাকাতুয়া, টিয়া, ময়না! আর কখনও বাঘ-সিংহের পিঠে চড়ে পেশিশক্তির আস্ফালন করছে মানব-মানবী।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশেও সার্কাস হয়ে ওঠে বিনোদনের এক বিরাট অনুষঙ্গ। শীত পড়তে না পড়তেই হাতি, ঘোড়া, বাঁদর নিয়ে হাজির হয়ে যেত সার্কাস দল।
তবে একসময় সার্কাস মানেই বোঝাত পশুদের খেলা। কিন্তু যখন থেকে আইন করে এই খেলায় বন্য পশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তখন থেকে মেলার সার্কাসের ভরসা কেবল মানুষ, বাঁদর-শিম্পাঞ্জি আর বড়জোর তোতা-ময়না জাতীয় কিছু পাখির খেলা।
খুব সরু লোহার রডের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাওয়া, রিঙের মধ্যে দিয়ে একসঙ্গে চার-পাঁচটা মোটরবাইকের দৌড়—এই ধরনের কসরত এখন সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ।
তবে এখনও কিছু গ্রামে সার্কাস চলে। একসময়কার এই শিল্প নানা কারণে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পশুপাখিদের নিয়ে খেলা প্রদর্শন। সার্কাসের উৎপত্তিস্থল গ্রিসে অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে এই খেলা। ২০১৫ সালের মধ্যেই ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও এটি বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ব অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার সংস্থা এবং ভারতীয় পশুপ্রেমীদের হস্তক্ষেপে এই শিল্প এখন প্রায় সব বড় শহরেই বন্ধ হওয়ার পথে। বন্যপ্রাণীদের পর্যাপ্ত খেতে না দেওয়া, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে শ্রমসাধ্য খেলা করানো, শারীরিক নির্যাতন এবং বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার মতো নানা কারণে আইন করে এই খেলা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
মূলত, মানুষ যে কারণে সার্কাস দেখতে যেত—অর্থাৎ পশুপাখির খেলা দেখতে—সেই উপাদানই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দর্শকরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এছাড়া শহুরে মানুষের কাছে এখন রয়েছে বিনোদনের নানা আধুনিক উপকরণ। দূরদূরান্ত থেকে এসে তাঁবু খাটিয়ে টানা খেলা দেখানোও খুব ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। যাদের কথা ভেবে সার্কাস দেখানো হয়, তারাই যদি না আসে, তাহলে ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে সার্কাস দলগুলোর জন্য।
ফলে ঐতিহ্যবাহী ও আনন্দদায়ক এই শিল্প এখন মৃতপ্রায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আশির দশকের শিশুদের স্মৃতিতে সার্কাসের জোরালো আমেজ থাকলেও নব্বইয়ের দশকের শিশুদের মধ্যে তা অনেকটাই ম্লান। আর ২০০০ সালের পর জন্মানো প্রজন্মটি তো সার্কাস দেখেইনি বলা চলে।
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সার্কাসের জায়গা দখল করে নিয়েছে শিশুপার্ক, ওয়ান্ডারল্যান্ড, ফ্যান্টাসি পার্ক। পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে, অন্য অনেক কিছুর মতোই হারিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের ছেলেবেলার প্রিয় সার্কাস।
এম.কে.