
ছবিঃ সংগৃহীত
মাঠের অভাব, মাটির দূরত্ব আর মনোযোগের বিচ্যুতি—বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ প্রাণ।
এক সময় বিকেল হলেই গ্রামের মাঠ, স্কুলের উঠোন, নদীর চর কিংবা খোলা মাঠ জুড়ে উঠত ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে প্রাণচাঞ্চল্য—“হাডুডু হাডুডু!” শ্বাস আটকে, চোখে আগুন নিয়ে ছোটাছুটি করা খেলোয়াড়েরা যেন যুদ্ধ করতে নামত, তবে সেটা ছিল নিখাদ আনন্দের যুদ্ধ। হাডুডু, আমাদের জাতীয় খেলা, এখন যেন শুধুই শোনানো গল্প হয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
আমাদের খেলা, আমাদের পরিচয়
হাডুডু কেবল একটি খেলা নয়—এটি লোকজ সাহস, শারীরিক কৌশল ও দলগত চেতনার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। একদল রক্ষার দায়িত্বে, আরেক দল আক্রমণে। "হাডুডু হাডুডু" বলে শ্বাসরুদ্ধ করে প্রতিপক্ষের এলাকায় প্রবেশ, তাদের স্পর্শ করে নিরাপদে ফিরে আসার মধ্যে ফুটে ওঠে কৌশল, সাহসিকতা আর শরীরচর্চার অপরূপ সংমিশ্রণ।
এটি বাংলাদেশের সরকারি স্বীকৃত জাতীয় খেলা। আন্তর্জাতিকভাবে এটি পরিচিত কাবাডি নামে।
হারিয়ে যাচ্ছে কেন?
-
খেলার মাঠের সংকট
-
শহুরে জীবনের ব্যস্ততা ও মোবাইল গেমের প্রতি আসক্তি
-
লোকজ খেলাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা
-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথাগত খেলাধুলা বাদ দিয়ে শুধুই পাঠ্যবইয়ের চাপ
-
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব
হাডুডু নিয়ে স্মৃতিচারণ
মোহাম্মদ মজনু মিয়া, বয়স ৭২, একজন প্রবীণ। পেশায় কৃষক। বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার এম. বালিয়াতলী ইউনিয়নে। তার চোখে আজও ঝিলিক মারে হাডুডুর সেই দিনগুলো।
তিনি বলেন, “ছেলেবেলায় খেতেই যাই না, খালি খেলি হাডুডু। ওই খেলাই আছিল জীবনের প্রথম জয় পাইবার জায়গা। কতোবার যে আমাগো দল ইউনিয়ন প্রতিযোগিতায় জিতসে! এখনকার ছেলেপুলা হাডুডু কন, কয় ‘ওটা আবার কী?’ শুনলে বুকটা ফেটে যায়।”
হাডুডুর উপকারিতা
-
ফুসফুস ও দেহের শক্তি বাড়ায়
-
কৌশল, ক্ষিপ্রতা ও সাহসিকতা তৈরি করে
-
দলগতভাবে কাজ করতে শেখায়
-
খেলোয়াড়দের মধ্যে বন্ধন ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে
-
কোনো যন্ত্রপাতি বা খরচ লাগে না—গ্রামের দরিদ্র শিশুরাও খেলতে পারে
এখন কী করা দরকার?
১. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হাডুডু প্রতিযোগিতা বাধ্যতামূলক করা
২. উপজেলা পর্যায়ে লোকজ খেলা উৎসব চালু করা
৩. মিডিয়ায় হাডুডু খেলাকে তুলে ধরা—নাটক, অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপনে
৪. স্থানীয় সরকার ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতা আয়োজন
৫. ‘হাডুডু দিবস’ পালনের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি
যদি আমরা এখনই লোকজ ঐতিহ্যের দিকে ফিরে না তাকাই, একদিন হয়তো আমাদের জাতীয় খেলা বলেই আর কিছু থাকবে না। হাডুডু শুধু খেলা নয়, এটি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের আত্মপরিচয়।
আধুনিকতার ধাক্কা থামানো যাবে না, কিন্তু ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে সামনে এগোনোও সম্ভব নয়।
আসুন—
হাডুডুকে ফিরিয়ে আনি, মাঠে ফেরাই প্রাণ, আর হৃদয়ে ফিরিয়ে আনি বাংলাদেশ।
ইমরান