
ছবি: সংগৃহীত
গাজার উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের উপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি চালিয়ে গত এক মাসে প্রাণ নিয়েছে অন্তত ৫৮৩ জন ফিলিস্তিনির। আহত হয়েছেন আরও চার হাজারের বেশি। এই মৃত্যু প্রতিদিন ঘটছে। খাবারের জন্য দাঁড়ানোই এখন গাজায় মৃত্যুর কারণ।
গত ২৭ মে থেকে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল-সমর্থিত এই সংস্থার পরিচালনায় চালু হওয়া কেন্দ্রগুলোতেই এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গাজার মানুষ এখন ভয় আর ক্ষুধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গুলির ভয়ে অনেকে ত্রাণকেন্দ্রে যেতে চান না, আবার না গেলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়।
এর আগে জাতিসংঘের অধীনে গাজায় ৪০০টি ত্রাণকেন্দ্র ছিল। এখন আছে মাত্র চারটি — তিনটি দক্ষিণে, একটি মধ্য গাজায়। উত্তরে যেখানে অবস্থা সবচেয়ে করুণ, সেখানে কোনো কেন্দ্র নেই। কেন্দ্রগুলো কখন চালু হবে, সেটাও আগে থেকে জানানো হয় না। কখনও কেন্দ্র খোলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয় সব ত্রাণ শেষ।
ত্রাণ নিতে গেলে মানুষকে অনেক দূর হেঁটে যেতে হয়, যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে, চেকপয়েন্ট ডিঙিয়ে। একেকজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। দুর্বল, বৃদ্ধ বা আহতদের পক্ষে এই পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। যারা যেতে পারেন, তারাও জানেন ফিরে আসতে নাও পারেন।
ত্রাণপ্যাকেটে যা থাকে, তা দিয়ে এক পরিবারের দু’দিনও চলে না। কিছু ময়দা, কিছু পাস্তা, দুই ক্যান বিনস, কয়েকটা বিস্কুট আর চা এটাই একেকটা বাক্স। পানি নেই, ওষুধ নেই, জ্বালানি নেই। খাবারের ক্যালোরি চাহিদারও অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। ফলে এই ত্রাণ আসলে জীবনের আশা নয়, বরং ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল একটি মরিয়া চেষ্টা।
ইসরায়েলের হা’আরেটজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৈন্যরা জানিয়েছেন, তাদের নিয়মিতভাবে ভিড় লক্ষ্য করে গুলি চালাতে বলা হয়। কোনো হুমকি না থাকলেও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। একজন বলেন, “প্রতিদিন এখানে এক থেকে পাঁচজন মারা যায়। এটা যেন এক হত্যার মাঠ।”
ইসরায়েলি বাহিনী জানায়, এসব গুলি "নিরাপত্তার কারণে" চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত মানুষের ঠাঁই নেই নিরাপত্তার ছায়াতলে।
এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে শিশুরা। ইউনিসেফ জানায়, শুধু মে মাসেই অপুষ্টিজনিত কারণে পাঁচ বছরের নিচে ৫ হাজারের বেশি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। গড়ে প্রতিদিন ১১২টি শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগে চিকিৎসা নিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিদিন শিশুরাও মারা যাচ্ছে।
এই দুর্ভিক্ষ আর সহিংসতা ইচ্ছাকৃত। আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার ৯৩ শতাংশ মানুষ এখন চরম খাদ্য সংকটে। একেকটি এলাকাতে অবস্থা এতটাই খারাপ যে, মানুষ নিজের ঘর ছেড়ে পায়ে হেঁটে অন্যত্র চলে যাচ্ছে শুধু বাঁচার জন্য।
ইসরায়েল গাজার মানুষকে বোমা ও গুলির পাশাপাশি এখন ক্ষুধার অস্ত্রেও আঘাত করছে। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নাম, নতুন শিশু। ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো মানুষ আর জানেন না— আজ খাবার পাবেন, না কি বিদায় নেবেন পৃথিবী থেকে।
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.