
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের বহুল আলোচিত ‘বিগ, বিউটিফুল বিল’ মার্কিন সিনেট পেরিয়ে আইনে পরিণত হওয়ার পথে। কিন্তু এই বিল পাস হওয়ার সম্ভাবনাই এখন বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতিমূলক ট্যারিফ নীতির কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন মার্কিন ট্রেজারিতে আগের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না।
মার্কিন কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত কর ছাড় ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির এই উদ্যোগ আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়াবে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ঋণের উল্লম্ফনে চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেয় মুডিজ।
জাপানের টোকিওভিত্তিক সিমপ্লেক্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের রেটস অ্যান্ড ক্রেডিট ফান্ড ম্যানেজার তোশিনোবু চিবা বলেন, "নিশ্চিতভাবেই আমি বাজেট ঘাটতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।" তিনি জানান, ট্রেজারি ছেড়ে ইউরোপীয় বন্ডে স্থানান্তরের জন্য ফিউচার ব্যবহার করছেন এবং ট্রাম্পের বিল পাস হওয়ার পরই মূল ক্যাশ মার্কেটে এই পরিবর্তন আনবেন।
চিবার মতে, ইউরোপীয় বন্ড, বিশেষ করে জার্মান ও ফরাসি বন্ডের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরও এখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে।এক সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পরিচিত মার্কিন ট্রেজারি বন্ড এখন আর আগের মতো নিরাপদ মনে করছেন না অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী। ট্রাম্পের ট্যারিফ ও করসংক্রান্ত অস্থির নীতির কারণে তাঁরা ডলার ও মার্কিন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
মার্কিন ট্রেজারি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাপিটাল (TIC) তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মার্কিন ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতে মোট ১৪.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সময়ে ট্রাম্প ঘোষিত ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’-এর কারণে বিশ্ববাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে প্রায় ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার জনসাধারণের হাতে থাকা ঋণ। জাপান এই মার্কিন ট্রেজারির সর্ববৃহৎ বিদেশি ধারক, যার হাতে রয়েছে ১.১৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাজ্য (৮০৭.৭ বিলিয়ন ডলার) এবং চীন (৭৫৭.২ বিলিয়ন ডলার)।
ট্যারিফ সংক্রান্ত ঘোষণার পর বাজারে ট্রেজারির দরপতন ঘটে। গত ২২ মে ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বেড়ে ৪.৬২৯ শতাংশে পৌঁছায়, যা পরে কমে দাঁড়ায় ৪.২৭৭ শতাংশে। এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত এই হার ৩.৯ শতাংশ থেকে ৪.৬২৯ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে।
ট্রাম্পের বিল চূড়ান্তভাবে পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থান নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও গভীর হতে পারে। এ নিয়ে মার্কিন সিনেটে চলমান বিতর্ক শেষ হওয়ার কথা সোমবার রাতে, যা এশিয়ার বাজার খুলতেই প্রভাব ফেলতে পারে।
বাইপার্টিসান পলিসি সেন্টারের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই বিলের ব্যয় হিসাব করতে রিপাবলিকান সেনেটররা ২০১৭ সালের করছাড় দীর্ঘায়িত হবে না এমন অনুমান করে ব্যয়কে তুলনামূলকভাবে কম দেখাতে চাইছেন, যা প্রকৃতপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বাঁচানো দেখাতে সাহায্য করছে।
আশমোর গ্রুপের লন্ডন-ভিত্তিক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা গুস্তাভো মেদেইরোস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ঘাটতি আরও বাড়বে এমন ধারণা ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীদের মার্কিন ট্রেজারি ছেড়ে নিজ দেশে অর্থ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করতে পারে। তিনি জানান, এপ্রিল মাসে যখন বড় বড় বন্ড মার্কেটগুলো পতনের মুখে পড়ে, তখন জার্মান বন্ড মার্কেট স্থির ছিল।
যদিও জার্মানির ঋণের পরিমাণও নতুন সরকারের ট্রিলিয়ন ইউরো ব্যয়ের পরিকল্পনার কারণে বাড়ছে, তবু জার্মানি একমাত্র জি৭ দেশ যার ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও ১০০ শতাংশের নিচে। এই বাস্তবতা জার্মান বন্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় অবস্থানে রাখছে।
মেদেইরোস বলেন, "এটি শুধু শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক সুযোগ তৈরি করছে না, বরং ঝুঁকিমুক্ত জার্মান বন্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ বন্ডের সরবরাহও বাড়াবে। এতে করে মূলধন ইউরোপে ফিরে আসার প্রণোদনা তৈরি হবে।"
তবে বিশ্লেষক মাসাহিকো লু মনে করেন, এই উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক হারে মার্কিন ট্রেজারি বিক্রি হয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা খুব কম। তিনি বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মার্কিন ট্রেজারি থেকে সরে আসা একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত প্রবণতা, তা হঠাৎ সৃষ্ট নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বিক্রি নয়, বরং বহুমুখীকরণের কৌশল। বিশেষ করে এশীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।"
স্টেট স্ট্রিটের সিনিয়র ফিক্সড ইনকাম স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে মাসাহিকো লুর বক্তব্যকে সমর্থন করে এসকিউব ক্যাপিটালের গ্রুপ সিআইও হেমন্ত মিশ্র বলেন, "বাজারে উদ্বেগ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে প্রিমিয়াম আরও বাড়বে। আমরা মনে করছি, ইউএস ক্রেডিট ডিফল্ট সুয়াপগুলো এখন আরও বেশি প্রিমিয়ামে ব্যবসা করবে, যা একই রেটিংপ্রাপ্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি।"
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক বিল এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিকেই নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। বিনিয়োগের বহুমুখীকরণ, ঝুঁকিমুক্ত পুঁজি স্থানান্তর এবং ঋণ ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ সব মিলিয়ে মার্কিন ট্রেজারি আর আগের মতো অবিচল ও নির্ভরযোগ্য মনে করছেন না অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী। আর এই বাস্তবতা আগামী দিনে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
সূত্র:রয়টার্স
আফরোজা