
ছবিঃ সংগৃহীত
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর। ভোরের আলো ফোটার আগেই ডিঙ্গি কোষা নৌকায় করে আড়িয়াল বিলে ভেসে পড়েন শতশত মানুষ। চারদিকে নিস্তব্ধ পানির ঢেউ—আকাশের রঙ ছুঁয়ে জলের ক্যানভাসে আঁকে ধূসর নীল। সেই জলরঙে ফুটে ওঠে শাপলার স্বপ্ন।
শাপলা—এই সাদা, গোলাপি ফুলটাই যেন বর্ষার দিনে আড়িয়াল বিলে বেঁচে থাকার একটিমাত্র হাতিয়ার। বিলপাড়ের গাদিঘাট, আলমপুর, লস্করপুর, আশুলিয়াসহ বিস্তীর্ণ গ্রামগুলোর শতশত পরিবার বর্ষা এলেই শাপলা কুড়িয়ে সংসারের হাড়ি চড়িয়ে নেন।
ভোর থেকে দুপুর—টলমলে পানির মাঝে মাথা গুঁজে থাকা শাপলাগুলো সাবধানে তুলে আনা হয়। ছোট নৌকায় আটি বাঁধা হয় শাপলা। শ্রীনগরের গাদিঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়—এক আটি শাপলা ২০ টাকা। ৬০ শাপলা বেঁধে একেকটি আটি। বিকেল নাগাদ গুনে গুনে পিকআপ-ভ্যানে শাপলার আটি তোলা হয়। পাইকাররা সেসব ঢাকায়—কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ি, শ্যামবাজার—বড় বড় সবজির আড়তে পাঠান।
বর্ষা এলেই আড়িয়াল বিল আর কিছু থাকে না—ফসল হয় না, মাঠ ডুবে যায়, আবাদ থেমে যায়। তবে এখানকার মানুষ থেমে থাকেন না। শাপলা কুড়িয়ে বিক্রি করেন, শামুক কুড়ান, মাছ শিকার করেন। অলস সময়টাও যেন রঙিন করে তোলেন জীবনের লড়াইয়ে। মোয়াজ্জেম হাওলাদার বলছিলেন—“দিনে হাজার টাকার মতো হয়ে যায় শাপলা বেচে। গাদিঘাট এলাকায় প্রায় শতাধিক মানুষ শাপলা কুড়াচ্ছে।”
পাইকার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “গেলবার দিনে ১০-১২ পিকআপ শাপলা নিয়েছি, এবার পানি কম তাই ৪-৫ ট্রাক যায়।” পানি বাড়লে আবার রমরমা ব্যবসা হবে—এ ভরসা তাদের।
তবে শাপলার এই সৌন্দর্য ও রোজগারের মধ্যেও আছে একখানি দীর্ঘশ্বাস। গাদিঘাট বাজার সেতু থেকে আশুলিয়ার হাওলাদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা খানাখন্দে ভরা। বেহাল রাস্তায় পণ্যবাহী গাড়ি নিয়ে যাওয়া দুঃস্বপ্ন। ভাঙা রাস্তার কারণে বেশি খরচ গুনতে হয়। এ নিয়ে ক্ষোভ ঝরল স্থানীয়দের কণ্ঠে—“রাস্তাটা ঠিক হলে ব্যবসা আরও বাড়বে।”
কিন্তু বিলের রূপ ভুলিয়ে দেয় সব ক্ষণিকের দুঃখ। বর্ষায় আড়িয়াল বিল এক অনন্য সৌন্দর্য—পানি ছলছল করে, দূরে সারি সারি শাপলা মাথা তোলে। ট্রলার আর নৌকা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই শাপলার রাজ্য দেখতে। মাঝি-মাল্লারাও ব্যস্ত হন নৌকা-ট্রলার ভাড়ায়।
যেন আড়িয়াল বিল নিজেই বলে—বর্ষায় আমি নতুন জীবন দেই, শাপলার হাসিতে বাঁচিয়ে রাখি মানুষকে। বিলের বুকে শাপলার ফুল নয়, ফুটে ওঠে মুন্সীগঞ্জের মানুষের টিকে থাকার গল্প, শ্রমের গৌরব আর বেঁচে থাকার মাধুর্য।
ইমরান