
ছবি: সংগৃহীত
একটি ছোট ভাড়া বাসা, বিধবা মা ও তার একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গেছেন সন্তানের বয়স যখন মাত্র দুই বছর। জীবনের শুরু থেকেই তাই সংগ্রামকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হয়েছে ছেলেটিকে। মায়ের সীমাহীন ত্যাগ আর নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে সে বড় হয়েছে, পড়াশোনা শেষ করেছে ডিগ্রি পর্যন্ত। কিন্তু সেই বহু কাঙ্ক্ষিত চাকরি তার ভাগ্যে জোটেনি।
তবে হাল না ছেড়ে, জীবন যুদ্ধে অবিচল থেকেছেন তিনি। নামটি এখানে 'মোজাম্মেল' হিসেবে উল্লেখ করা হলো, যদিও এটি তার প্রকৃত নাম নয়—ব্যক্তিগত সম্মানবোধের কারণে পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
মোজাম্মেল ভাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কাগজের ঠুঙ্গা বানানো ও তা বাজারে সরবরাহ করার কাজ। অনেকে যেটিকে তুচ্ছ মনে করেন, সেটিকেই তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন জীবনের মূল উপার্জনের পথ হিসেবে। সারারাত জেগে ঠুঙ্গা বানাতেন আর ভোরে সেগুলো নিয়ে যেতেন বাজারে। সেই সামান্য আয়েই চলত মা-ছেলের জীবনের চাকা।
আমি তখন পাড়ার এক তরুণ। প্রায়ই যেতাম তার ছোট্ট ঘরটিতে। দেখতাম, কী নিষ্ঠা আর মনোযোগ নিয়ে তিনি কাজ করেন। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম—"ভাই, এভাবে কষ্ট করে কাজ করে আপনি কি সত্যি ভাগ্য বদলাতে পারবেন?"
তিনি হেসে বলেছিলেন, “রুবেল, কাজ যত ছোটই হোক না কেন, যদি মন থেকে করি—একদিন সেটাই বড় কিছু হয়ে দাঁড়াবে। আমার কাছে বড় কিছু নেই, তবু ছোট ছোট সঞ্চয় জমিয়ে একদিন ব্যবসা শুরু করবো।”
তার সেই আত্মবিশ্বাসময় কথা শুনে আমি তখন যতটা না অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি হয়েছি অনুপ্রাণিত। সময়ের স্রোতে আটটি বছর কেটে গেছে। তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
ঢাকায় এসে একদিন এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। টিএসসি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, ফাইল হাতে। হঠাৎ একটি কালো গ্লাসের প্রাইভেটকার আমার সামনে এসে থামে। চালক এসে বললেন, “স্যার আপনাকে ডাকছেন।”
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কিন্তু বুঝলাম, বিষয়টি আমার সঙ্গেই। গাড়িতে উঠে দেখি, একজন ভদ্রলোক রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন। নিয়ে গেলেন একটি বড় অফিস ভবনে। তার চেম্বারে বসে যখন তিনি বললেন—"তুমি কি ঠুঙ্গা মোজাম্মেল ভাইকে ভুলে গেছো?"—তখন যেন মুহূর্তেই আমার অতীত ফিরে এলো।
তিনি নিজেই মোজাম্মেল ভাই। সেই কাগজের ঠুঙ্গা বিক্রেতা এখন একজন সফল ব্যবসায়ী, নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। সময়ের সঙ্গে বদলেছে তার অবস্থান, চেহারায় এসেছে পরিবর্তন, কিন্তু হৃদয়ে রয়ে গেছে অতীত আর সম্পর্কের সৌন্দর্য।
এটা শুধু একজন মানুষের গল্প নয়—এটা প্রমাণ যে, পরিশ্রম কখনো বিফলে যায় না। ছোট কাজের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে বড় স্বপ্নের বীজ। সময়, অধ্যবসায় আর আত্মবিশ্বাস মিললে জীবন বদলাতে পারে নাটকীয়ভাবে—যা বাস্তব হয়েও অলীক মনে হয়।
নোভা