
ছবি: প্রতীকী
নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কেউ দেখতে সুন্দর, কেউ ধনী, কেউ আবার অনেক সফল— এইসব দেখে আমরা নিজের অজান্তেই ভাবি, “আমি কেন পারছি না?” এই তুলনা অনেক সময় আমাদেরকে একটু ভালো করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু যখন এই তুলনা থেকেই জন্ম নেয় হীনম্মন্যতা, আত্মঅবিশ্বাস বা ঈর্ষা, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় বিপজ্জনক।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই তুলনাকে আরও বেশি তীব্র করে তুলছে। আমরা অন্যের জীবনের যত ভালো দিক দেখি, নিজের জীবনের দুঃখটাই যেন তখন বেশি চোখে পড়ে। কারও ভ্রমণের ছবি, কারও চাকরির খবর, কারও সুখী সম্পর্ক সব দেখে নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে হতে শুরু করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ‘অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা’ যদি নিয়মিত হয় এবং তা থেকে যদি আপনি হতাশ, বিষণ্ন বা অক্ষমতা বোধ করেন, তাহলে এটি হতে পারে মানসিক সমস্যার একটি লক্ষণ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, “তুলনা তখনই ক্ষতিকর হয়, যখন আপনি নিজের আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেন। এটা দীর্ঘদিন চললে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়, মানসিক অবসাদ তৈরি হয় এবং কখনো কখনো তা ডিপ্রেশনের রূপও নিতে পারে।”
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সমস্যা মানুষ নিজের মধ্যে সহজে ধরতে পারে না। একজন ব্যক্তি হয়তো নিজের অসফলতা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করছেন, নিজের শরীর, মুখ বা অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে লজ্জা পাচ্ছেন— এসবই ধীরে ধীরে মানসিক অসুস্থতার দিকে ইঙ্গিত করে।
বিশেষ করে যারা নিজেকে বারবার বলছেন, “আমি কোনো কিছুতেই ভালো না”, “অমুকের মতো হতেই পারলাম না”, “আমার জীবনে কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না”— তারা আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে ফেলেন। এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা একসময় উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, আত্মগ্লানি এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত গড়াতে পারে।
তবে সবাই যে অন্যের সঙ্গে তুলনা করলে মানসিক রোগে ভুগবেন, তা নয়। যেকোনো মানুষ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে অন্যের সঙ্গে তুলনা করেই থাকেন। কিন্তু যখন এই তুলনা আপনার জীবনের সবখানে প্রভাব ফেলে, তখন সেটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম শর্ত হলো নিজের সচেতনতা। আপনি যদি বুঝতে পারেন যে আপনি প্রায়ই অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছেন এবং তাতে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন— তাহলে আপনাকে থামতে হবে।
নিজের শক্তি ও দুর্বলতা চিনতে পারা, নিজের অগ্রগতি ছোট হলেও তা উদযাপন করা এবং জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া— এই অভ্যাসগুলো মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, দিনে কিছুটা সময় শুধু নিজের জন্য রাখা, প্রতিদিন ইতিবাচক কথা ভাবা এবং নিজের অর্জনগুলো লিখে রাখা খুবই উপকারী। প্রয়োজনে কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়াও বিচক্ষণতা।
অন্য কেউ কতটা এগিয়ে গেল, সেটা নয়— আপনি কোথা থেকে কোথায় এলেন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করা যদি আপনাকে কষ্ট দেয়, আপনার আত্মসম্মান নষ্ট করে, তবে তা নিছক ‘অভ্যাস’ নয়, বরং মানসিক সুস্থতার জন্য হুমকি। সময় থাকতে সচেতন না হলে তা পরিণত হতে পারে বিষণ্নতা বা উদ্বেগজনিত মানসিক রোগে। তাই নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের গতিতে হাঁটুন। নিজেকে অন্যের সঙ্গে নয়, তুলনা করুন আগের নিজের সঙ্গে। তাহলেই মানসিক শান্তি আর আত্মবিশ্বাস থাকবে ঠিকঠাক।
এম.কে.