
সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯ সালে প্রাচীন রোম থেকে প্রকাশিত হতো অ্যাক্টা ডিউরনা বা ডেইলি ইভেন্টস নামে হাতে-লেখা এক সংবাদপত্র। এটি মূলত যুদ্ধসংক্রান্ত সংবাদ এবং রাজনৈতিক তথ্য বহন করত, যা জনসমাগমস্থলে উন্মুক্ত থাকত। অনেক
ঐতিহাসিক মনে করেন, এই অ্যাক্টা ডিউরনা থেকেই শুরু সাংবাদিকতার সূচনা।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ সনে মৌর্য বংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্তের সময় ওভারসিয়ার বা প্রতিবেদক হিসেবে এক ধরনের লোক নিয়োজিত ছিলো, তাদের কাজ ছিলো মূলত গুপ্তচরবৃত্তি করা। কিন্তু সম্রাট অশোকের শাসনামলে পাল্টে যায় ওভারসিয়ারদের কাজের ধরণ। খবর সংগ্রহ করার পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মের গুণাবলী এবং তার সাফল্য প্রচারও কাজ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবেদকদের। সেখানেই যেন গড়ে উঠতে থাকে সাংবাদিকতা পেশার প্রাচীন শিকড়। সম্ভবত সেই স্মৃতিই বহন করছে, আজকের দিনের রিপোর্টারদের প্রতিবেদক নামকরণ।
বই বা অন্যান্য মুদ্রণের কাজ শুরু করার আগে, মানুষ রপ্ত করেছিলো ছাপার কৌশল। জাপানিরা অষ্টম শতকে কাঠের বল্কে কালি লাগিয়ে কাগজ ছাপার কাজ করতো। ওয়াং চিহ্ নামে এক চীনা নাগরিক তার বাবা-মায়ের স্মরণে একটি বই ছেপেছিলেন, তাতে তারিখ দেওয়া ছিল ১১ মে, ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দ। বিশ্বাস করা হয়, চীনারাই প্রথম ‘মুভেবল টাইপ বা মুদ্রাণাক্ষর’ আবিষ্কার করেছিলেন। ১০৪০ সালের দিকে পি সেং এই মুদ্রণ ব্যবস্থা সূচনা করেন। কিন্তু চীনা বর্ণের জটিলতা ও প্রতীকাত্মক রুপ সেই অগ্রগতিকে কঠিন এবং শ্লথ করে দিয়েছিল।
নগর সভ্যতায় মেসোপটেমিয়া ও মিশরে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে লিখন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটেছিল অনেক আগেই। কিন্তু সেই লিখন পদ্ধতি পূর্ণতা পায় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তার আগে পর্যন্ত মুদ্রণ সাংবাদিকতার সত্যিকারের সূচনা হয়নি। ১৪৫৫ সালে জার্মানির ‘জোহানেস ভন গুটেনবার্গ’ প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার করেন। তিনি নিজেও জানতেন না, তার এই যন্ত্র একদিন পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেবে। এরপর তিনি মেইনজ শহরে তার প্রথম প্রেস স্থাপন করেন। প্রথম দিকে ছাপাতেন স্বীকারোক্তি দেয়া পাপীদের ক্ষমা করার পোপ অনুমোদিত অঙ্গীকারনামা। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাবের কারণে এসব সনদের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
১৪৫৬ সালে গুটেনবার্গ ও তার সহকারী মিলে ছেপে ফেলেন তিনশত কপি বাইবেল। যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ নামে। এই বাইবেল শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি ছিল মুদ্রণ প্রযুক্তির সম্ভাবনার এক জীবন্ত দলিল। প্রায় ১২৮০ পৃষ্ঠার বাইবেলে প্রতিটি পাতায় ছিল ৪২টি করে লাইন। তখন থেকেই মূলত মুদ্রণের ধারাবাহিক ইতিহাসের সূচনা ঘটে, যা সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার ভিত্তি নির্মাণে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। সাংবাদিকতার সাথে মুদ্রণযন্ত্রের সম্পর্কটা এতো গভীর যে, তার আবিষ্কার ও উৎকর্ষ সাধনে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের প্রতি আজকের সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা না জানিয়ে উপায় নেই।
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হলেও সাংবাদিকতার সূচনা শুরু হয় তারও অনেক পরে। পনেরো শতকে লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়ে গেলেও ষোলো শতকেও ভেনিস শহরে থেকে প্রকাশিত হতো হাতে-লেখা প্রাচীরপত্র। তার নাম ‘নোটিজিসক্রিট’ বা লিখিত নোটিশ। তবে এই প্রাচীরপত্র পড়তে গেলে ইতালির মুদ্রা এক ‘গেজেটা’ করে দিতে হতো। সেই থেকে খবরের কাগজের নামের সঙ্গে গেজেটা কথাটা যুক্ত হয়ে গেছে। আজও বিভিন্ন পত্রিকার নামের শেষে আমরা গেজেট শব্দটা পাই। ১৯৮৭ সালে ডাব্লিউ. ডনসবেচ বলেন, বিশ্বে প্রথম পেশাদারি এবং বাণিজ্যিকভাবে খবর সংগ্রহ ও প্রচার শুরু হয় ষোড়শ শতকে, ভেনিস নগরে। যেখানে নোটিশ লেখকরা সব রকমের খবর সংগ্রহ করতো, কপি করতো এবং বিক্রি করতো।
ষোলো শতকে প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো জার্মানিতে। ১৬০৯ সালে উলফেনবাটেন থেকে প্রকাশিত হয় আভিসো এবং স্ট্রেসবার্গ থেকে প্রকাশিত হয় রিলেশন পত্রিকা। এরপর অল্প সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একের পর এক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। হল্যান্ডে ১৬১৮ সালে, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে ১৬২০ সালে, ইতালিতে ১৬৩৬ সালে।
প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১৬৫০ সালে লিপজিগ থেকে, নাম আপকামিং নিউজপেপার। ব্রিটেনের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ডেইলি কুরান্ট প্রকাশিত হয় ১৭০২ সালে। সতেরো শতকে সংবাদপত্রগুলো ছাপা হতো গড়ে একশ থেকে দুইশ কপি, অবশ্য ফ্রাঙ্কফুট জার্নাল এর ১৬৮০ সালেই সার্কুলেশন ছিলো দেড় হাজার কপি।
সংবাদপত্রের ইতিহাস কেবলই মুদ্রণের ইতিহাস নয়, এটি একটি অনবরত সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীন মতপ্রকাশ, তথ্যের প্রবাহ এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস।
১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণায় এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী মানবাধিকার ঘোষণায় প্রথমবারের মতো ‘প্রেসের স্বাধীনতা’কে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আজকের পৃথিবীতে প্রেসের স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। রিপোটার্স উইথআউট বর্ডারস এর ২০২৪ সালের ‘প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’-এ জানায়, ২০২৪ সালের ইনডেক্সে বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম।
মধ্যযুগে ভারতবর্ষেও আমরা হাতে-লেখা সংবাদপত্রে কথা জানতে পারি। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে কাফী খান নামে একজন পণ্ডিত তার ‘মুন্তাখাব-উল-লুবাব' গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শিবাজীর বাড়ির জনৈক রাজারামের মৃত্যুর খবর সম্রাটের শিবিরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে পৌঁছেছিল’। একটি হাতে-লেখা সংবাদপত্রের মাধ্যমে এই খবর পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, এ অঞ্চলের এটাই সবচেয়ে প্রাচীন হস্তলিখিত সংবাদপত্র।
১৮২৮ সালে কর্নেল জেমস টড মুঘল দরবারের কয়েক শত হাতে লেখা সংবাদপত্র আবিষ্কার করে, লন্ডনের এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠান। এসব কাগজগুলো লম্বায় ছিল ৮ ইঞ্চি চওড়ায় ৪.৫ ইঞ্চি। এসবের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে থাকতো শুধু রাজকীয় খবর। সম্রাট আকবরের সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত আবুল-ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের ১৬৯ ধারায় তিন ধরনের লোকের কথা বলেছেন। তার গ্রন্থে এই তিন ধরনের লোকের কথা বিস্তারিত না বললেও আমরা জানতে পারি ভেনিসের পরিব্রাজক নিকালো ম্যানুচি’র ‘স্তোরিয়া দো মোগর’ গ্রন্থ থেকে। তারা হলেন ওয়াকিয়া নবিশ (সরকারি প্রতিবেদক), খুফিয়া নবীশ (গুপ্ত সংবাদদাতা) এবং হরকরা (খাশ প্রতিবেদক)।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রটি ইউরোপ থেকে আসে ১৫২৬-২৭ সালের দিকে। মতান্তরে ১৫৫৬ সালে। পর্তুগিজ পাদ্রীরা আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) যাবার পথে ঘটনাক্রমে তাদের মুদ্রণ যন্ত্রটি গোয়ায় ফেলে যেতে বাধ্য হন।
ভারতবর্ষে প্রথম ১৭৬৮ সালে সংবাদপত্র প্রকাশের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম বোল্টস্। তিনি ছিলেন কোম্পানিরই কর্মচারী। কিন্তু কোম্পানির লোকেরা সম্ভাব্য বিপদের গন্ধ পেয়ে বোল্টস্ সাহেবকে জোরপূর্বক জাহাজে করে দেশে পাঠিয়ে দেন। সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ এভাবেই সমাপ্তি হয়।
এর ঠিক ১২ বৎসর পর অর্থাৎ ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্র চালু করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। নাম ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভারটাইজার’। হিকি এ পত্রিকা বের করেন বলে একে ‘হিকির গেজেট’ বলেও সম্বোধন করা হয়। এরপর ইন্ডিয়া গেজেট (১৭৮০), ক্যালকাটা গেজেট (১৭৮৪), বেঙ্গল জার্নাল (১৭৮৫), ক্যালকাটা ক্রনিকল (১৭৮৬) ইত্যাদি একের পর এক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
বাঙালি মালিকানায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেট’। প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচাৰ্য। শ্রীরামপুর মিশনারিদের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র “সমাচার দর্পন” প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ২৩ মে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায়। এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং এর মূল্য ছিলো দেড় টাকা। এরপর রাজা রামমোহনের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘সম্বাদকৌমুদি’। ১৮২৯ সালের ৫ মার্চ ভবানীচরন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বের হয় ‘সমাচারচন্দ্রিকা’।
১৮৩৩ সালের মধ্যে ভারতে মোট প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮ টি। বস্তুত ব্রিটিশ গভর্নর উইলিয়াম বেন্টিংকের শাসনকাল থেকে চার্লস মেটকাফের পর্যন্ত (১৮২৮-১৮৩৫) সময়কে ভারতীয় সাংবাদিকতার ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এ সময়ে সংবাদপত্র যতখানি স্বাধীনতা ভোগ করেছে তা বৃটিশ শাসিত ভারতে আর কখনও করেনি।
প্রথমদিকে সংবাদপত্রের উপর কোনও আইনগত নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হতো। হিকির গেজেটের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেয় পত্রিকা বিলি বন্ধ করে, মানহানির মামলা দেয়, এমনকি মুদ্রণের টাইপ বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরবর্তীতে আইনগত নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে সীমিত করে তোলে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তিনির্ভর সেন্সরশিপ ও অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতিহাস থেকে দেখতে পেলাম, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের সূচনা কোনো একক মুহূর্তে হয়নি। এটি এক দীর্ঘ অভিযাত্রা যেখানে মৌখিক বার্তা থেকে শুরু করে গুটেনবার্গের ছাপাখানা, মুঘল দরবার থেকে হিকির গেজেট, প্রতিটি স্তরেই সমাজ ও রাজনীতির রূপরেখা ফুটে উঠেছে। আজকের সাংবাদিকতার মূল যে প্রশ্ন তথ্যের স্বাধীন প্রবাহ, জনগণের অধিকার ও ক্ষমতার জবাবদিহি সেটি ইতিহাস থেকেই উৎসারিত। অতীত জানলে আমরা বুঝতে পারি, সাংবাদিকতা কেবল খবরের কাগজ নয়, সময়ের আয়নায় সত্যকে খোঁজার এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস। সে কারণেই সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি এক আদর্শচর্চা।
লেখক: সংগীত কুমার, শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
নোভা