
ছবিঃ সংগৃহীত
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথাযথভাবে উন্নত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সবার জানা, বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো অত্যন্ত খারাপ, কারণ ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষণ পদ্ধতি আধুনিক নয়। যুগোপযোগী পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য। এ সমস্যা মোকাবিলায় জেনারেটিভ এআই, যা কয়েক বছরের মধ্যেই দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই জেনারেটিভ এআই ব্যবহৃত হচ্ছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের জন্য জেনারেটিভ এআই শিক্ষার অবকাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করতে পারে। তবে এটি সতর্কতার সঙ্গে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে এই প্রযুক্তি ইতিবাচক ও গঠনমূলকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে বেশ গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। একটি বড় সমস্যা হলো, শিক্ষার্থীরা এখনো মুখস্থবিদ্যার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, যার ফলে তারা কোনো বিষয়বস্তুকে ধারণা ও উপলব্ধির বদলে অন্ধভাবে অনুশীলন করে আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করে। এর ফলে তাদের সৃজনশীল চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা সীমিত হয়ে যায়।
তাছাড়া, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষক সংকট রয়েছে। এসব জায়গায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত অনেক বেশি, যার কারণে শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা মূল ধারণাগুলো যথাযথভাবে আত্মস্থ করতে পারে না। এই সমস্যাগুলো এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে, যা শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারের জন্য উপযুক্তভাবে প্রস্তুত করতে পারে না এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করলে, শিক্ষা ব্যবস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
জেনারেটিভ এআই, যেমনটি এর নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি বিদ্যমান তথ্যের ভাণ্ডার ব্যবহার করে নতুন নানা ধরণের তথ্য তৈরি করতে পারে—যেমন লেখা, সংগীত, চিত্র, ভিডিও ইত্যাদি। প্রচলিত সফটওয়্যারের তুলনায়, জেনারেটিভ এআই যেমন GPT এবং DALL·E মানুষের সৃজনশীলতার মতো নতুন আউটপুট তৈরি করতে পারে। এই প্রযুক্তি বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে, বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই জেনারেটিভ এআই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রথমত, এটি শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীর শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারে এবং একটি উপযুক্ত পড়াশোনার পরিকল্পনা ও শেখার পদ্ধতি তৈরি করতে পারে যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী আরও কার্যকরভাবে শিখতে পারে।
এটি শিক্ষাক্ষেত্রে যে ফাঁক রয়েছে তা পূরণ করতে পারে এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপন এমনভাবে করতে পারে যাতে ছাত্ররা আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে শিখতে পারে। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিকে আরেকটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে—পাঠ্যক্রম, কুইজ এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ অনুশীলন তৈরিতে। জেনারেটিভ এআই একটি বিস্তৃত পরিসরের পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারে, যা বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখতে শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। এটি শিক্ষার জন্য উপকরণের সীমাবদ্ধতা দূর করে উচ্চমানের শিক্ষার উপকরণে রূপ নিতে পারে।
এআই-উৎপাদিত কনটেন্ট নিশ্চিত করবে যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে সময়োপযোগী পাঠ্যবই, পরীক্ষণ পদ্ধতি ও যুগোপযোগী উপকরণ থাকবে।
বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি ভাষা শেখানো একটি গুরুতর সমস্যা। আমরা সবাই জানি, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেটিভ এআই টুলস ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারঅ্যাকটিভ অনুশীলন, কথোপকথনের অনুশীলন, ব্যাকরণ চর্চা ও তাৎক্ষণিক সংশোধনের মাধ্যমে ইংরেজি শেখার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে। এই টুলগুলো শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করবে।
এআই শিক্ষার মূল্যায়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়াতেও বিপ্লব ঘটাতে পারে। প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিগুলো সময়সাপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর জন্য সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন দিতে ব্যর্থ হয়, যা শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেটিভ এআই এই সমস্যা সমাধানে সহায়তা করতে পারে, দ্রুত মূল্যায়ন প্রদান করে এবং ছাত্রদের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে।
যদিও জেনারেটিভ এআই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অনেক সম্ভাবনাময়, এটি বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। একটি প্রধান বাধা হলো ডিজিটাল বিভাজন। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকাগুলোর অবকাঠামো এখনো দুর্বল। এসব জায়গায় জেনারেটিভ এআই সঠিকভাবে কাজ করতে হলে প্রয়োজন ভালো ইন্টারনেট সংযোগ, আধুনিক কম্পিউটার ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সুবিধা। এই সুবিধাগুলো ছাড়া এআই টুলস কার্যকরভাবে ব্যবহার সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধানে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকার, এনজিও এবং স্টার্টআপদের এগিয়ে আসা জরুরি।
শিক্ষক প্রশিক্ষণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষকরা যদি এই টুলগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে না পারেন, তবে শিক্ষার্থীদের উপকার হবে না। তাই তাঁদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানাতে হবে—জেনারেটিভ এআই কীভাবে সাহায্য করতে পারে এবং কীভাবে এটি পাঠ পরিকল্পনায় সংযুক্ত করা যায়। সেই সঙ্গে, কোন কোন তথ্য ব্যবহারযোগ্য এবং গোপনীয়তা রক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোও পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে।
এআই টুলসকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একীভূত করতে হলে নৈতিক বিষয়গুলো যেমন তথ্যের গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তির অতিনির্ভরতা—সাবধানে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এআই যেন শিক্ষকের বিকল্প না হয়ে পরিপূরক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। এআই বাস্তবায়নে আর্থিক খরচও একটি চ্যালেঞ্জ এবং বিদ্যালয়গুলোর জন্য সরকারের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সরকারের এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
জেনারেটিভ এআই ব্যবহারে কিছু বিদ্যালয় নির্বাচন করে সেখানে পাইলট প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। তথ্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর, ধাপে ধাপে জাতীয় পর্যায়ে এর সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল ও নীতিমালার মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে, অভিভাবক, শিক্ষক ও অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত, যাতে এআই ব্যবহারের দিকনির্দেশনা, সমস্যার সমাধান ও প্রযুক্তির সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা যায়।
জেনারেটিভ এআই বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। এখানে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত করা সম্ভব হবে এবং শিক্ষণ পদ্ধতি হয়ে উঠবে আরও আধুনিক। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নীতিনির্ধারক, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে, বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
ইমরান