ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

বৃক্ষপ্রেমিকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে দেখা মিলল বিরল প্রজাতির কেলিকদম গাছ

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৬:৪১, ১ জুলাই ২০২৫

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে দেখা মিলল বিরল প্রজাতির কেলিকদম গাছ

বর্ষার দূত কদম। বৃষ্টিভেজা দিনে কদম ফুলের সৌন্দর্য আর সুবাস নিয়ে কতই না রচিত হয়েছে কবিতা আর গান। প্রজাতি হিসেবে দেশে দুই প্রকার কদমের দেখা মেলে—সাধারণ কদম আর কেলিকদম। সাধারণ কদম গ্রাম বাংলার ঝোপজঙ্গলে সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু কেলিকদম বিরল বৃক্ষ। আর এ বিরল কেলিকদমের দেখা মিলেছে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে। বিষয়টি বৃক্ষপ্রেমিকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

টাঙ্গাইল বন বিভাগের এক তথ্যে জানা যায়, কেলিকদম শালবনের সহযোগী বৃক্ষ। আমলকী, বহেড়া, হরীতকী, সোনালু ও কুচির মতোই কেলিকদম শালবনে শোল পেত। কিন্তু টানা সাড়ে তিন দশক ধরে শালবনের গজারি ও সহযোগী বৃক্ষ নিধন করে বিদেশি প্রজাতির আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের মতো বৃক্ষে বাণিজ্যিক বনায়ন হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় ক্ষতিকর বনায়নে প্রাকৃতিক বন উজাড়ের পাশাপাশি দেশি প্রজাতির বহু বৃক্ষ, ভেষজ উদ্ভিদ ও গুল্মলতা বিলুপ্ত হয়। এ সর্বনাশা বনায়নে হারিয়ে যায় কেলিকদম।

এক মাস আগে মধুপুর বনাঞ্চলের জাতীয় সদর উদ্যান রেঞ্জের ফরেস্টার মোশারফ হোসেন গাছাবাড়ি বিটের গজারি বনে দুটি কেলিকদম গাছের সন্ধান পান। তিনি জানান, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ হাইওয়ে সড়কের মধুপুর উপজেলার বড়বাইদ এতিমখানার কাছাকাছি গজারি বনে কেলিকদম গাছ দুটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বর্ষায় প্রচুর ফুল ধরেছে। মৌমাছি ও প্রজাপতি ফুল থেকে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি কেলিকদম গাছ নিয়ে দুই মিনিটের একটি ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করেন। এতে সর্বত্র সাড়া পড়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। এরপর থেকেই অনেকেই কেলিকদম দেখার জন্য আসছেন।

টাঙ্গাইল বন বিভাগের তথ্যে আরও জানা যায়, কেলিকদম শালবনের সহযোগী বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Mitragyna parvifolia। একে ধূলিকদম্ব নামেও ডাকা হয়। ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর দেখা মিললেও বাংলাদেশে এটি এখন দুর্লভ। সাধারণ কদম গাছ আকারে বড়—পাতা, ফুল, ফলও বড়। কিন্তু বহুশাখা বিশিষ্ট পত্রমোচী কেলিকদম গাছ আকারে ছোট। পাতা, ফুল বা ফলও ছোট। হলুদ রঙের ফুল বৃত্তাকার ও সুগন্ধযুক্ত হয়। গাছের পাতা, কুঁড়ি, ছাল ও শেকড় ভেষজ হিসেবে সমাদৃত।

কেলিকদম নিয়ে ভারতের প্রাচীন কবিরা অনেক শ্লোক লিখেছেন। কৃষ্ণভক্তরা তো কেলিকদমকে পবিত্র বৃক্ষ মনে করেন। বীজ ও কলমের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার সম্ভব বলে মনে করেন উদ্ভিদবিদরা।

সৌখিন বৃক্ষপ্রেমিক ও গবেষক তাপস বর্ধন জানান, তিনি গাছাবাড়ি বিটের শালবনে দুটি বিরল কেলিকদম গাছ দেখে এসেছেন। দুর্লভ গাছ দুটিকে সংরক্ষণ খুবই জরুরি। গাছচোরেরা যেন হাইওয়ে সড়কের পাশের এই গাছের নাগাল না পায়, তা নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি এর বংশবিস্তার করা খুবই জরুরি। ছায়াদানকারী, অর্নামেন্টাল এবং ভেষজ গাছ হিসেবে সংরক্ষিত বনভূমি ছাড়াও সড়ক ও প্রাতিষ্ঠানিক বনায়নে এর সম্প্রসারণের সুপারিশ করেন তিনি।

অবসরপ্রাপ্ত উদ্ভিদবিদ ড. নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, সাধারণ কদমের চেয়ে কেলিকদমের পাতা ও ফুল ছোট হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের শালবন এলাকায় একসময় প্রচুর কেলিকদম গাছের দেখা মিলত। কিন্তু সামাজিক বনায়নের নামে সংরক্ষিত বনভূমিতে দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির গাছের বাণিজ্যিক বনায়ন করায় প্রাকৃতিক বন যেমন উজাড় হয়ে যায়, তেমনি গজারি ছাড়াও এর সহযোগী মূল্যবান দেশি গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এসব কারণে কেলিকদম বিনাশ থেকে রেহাই পায়নি।

তিনি আরও বলেন, সরকার প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ নিষিদ্ধ করেছে। মধুপুর শালবন পুনরুদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় বন বিভাগ নার্সারি ও পুনর্বনায়নের মাধ্যমে কেলিকদমকে তার চিরচেনা রাজত্বে সহজেই ফিরিয়ে আনতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

সানজানা

×