
বর্ষায় ফুটেছে দৃষ্টিনন্দন চালতা ফুল
চালতা বা চালতা ফুল নিয়ে অনেক কবিতা লেখা আছে। তবে বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘সেই দিন এই মাঠ’ কবিতার অংশে তিনি লিখেছেন, সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! আমি চলে যাব বলে চালতা ফুলটি আর ভিজবে না, শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে ? /লক্ষèীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষèীটির তরে? কত বিচিত্র আমাদেরই বাংলাদেশে বারোমাসই কত ফুল ও ফল হয় প্রকৃতিতে। চোখ জুড়ানো ফুল ও ফল না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না অপরূপ দৃষ্টি নন্দন ফুল ও বহুবিধ ভেষজ ঔষধি গুণসম্পন্ন বিস্ময়কর ফল চালতা। চালতা ফুলের বিকাশ ও পরিপূর্ণতা বড়ই বৈচিত্র্যময়।
একটি পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত চালতা ফুল কতটা সৌন্দর্যময় যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এর ফল বহুবিধ ঔষধি গুণসম্পন্ন হলেও মূলত এর চাটনি বা আচার আমাদের দেশে মুখরোচক ও লোভনীয় খাবার হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত। একটি চালতা গাছে বছরে একবারই ফল ধরে। প্রতিটি চালতা ফল স্বাভাবিকভাবে ৩০০ থেকে ৫৫০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়। চালতা গাছে প্রথমে ফুল ধরে। ফলের আকার যখন ডিমের আকৃতি ধারণ করে তখন ওই ফলের মধ্যে থেকে অপরূপ বাহারি ধরনের ফুল ফুটে। সাধারণত চালতা ফুল রাতে ফোটে। ফুল ফোটার একদিনের মধ্যেই ফুলের পাপড়িগুলো নিস্তেজ হয়ে ঝরে যায়। একটি ফলে একদিনের জন্যই পরিপূর্ণ একটি ফুল ফুটে আবার ঝরে পড়ে।
চালতা লিভারের টনিক হিসেবে কাজ করে। আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুবিধ ঔষধি গুণসম্পন্ন চালতা গাছ দেখা গেলেও বর্তমানে চালতা গাছ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো বন-জঙ্গলে বা বাড়ির আঙিনায় চালতা গাছ দেখা যায় না। চালতার বৈজ্ঞানিক নাম (ডিলিনিয়া ইনডিকা) এক রকমের ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ। এর ইংরেজী নাম (এলিফ্যান্ট আ্যাপল) চালতার ফল খুব আদরণীয় নয়। এটি স্থানবিশেষে চালিতা, চাইলতে ইত্যাদি নামে অভিহিত। দেখতে সুন্দর বলে শোভাবর্ধক তরু হিসেবেও কখনো কখনো উদ্যানে বা বাড়ির আঙিনায় লাগানো হয়ে থাকে। চালতার জন্ম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশে চালতা জন্মে। চালতা গাছ মাঝারি আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ।
এ গাছ উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। গাছের গায়ে লালচে রংয়ের চকচকে বাকল থাকে। পাতার কিনারা খাজ কাটা, শিরা উঁচু সমান্তরাল। চালতার সাদা রঙের ফুল দেখতে সুন্দর; এটি সুগন্ধময় ফুলের ভেতরে হলুদ পাপড়ি কাটা। ফুলের ব্যাস ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার একটি ফুলে ৫টি মোটা পাপড়ি থাকে, বৃতিগুলো সেসব পাপড়িকে আঁকড়ে ঘিরে থাকে। মে থেকে জুন মাসে চালতা ফুল ফোটার মৌসুম। চালতা ফল বর্ষার পর পাকে, শীতকাল পর্যন্ত এ ফল পাওয়া যায়। পাকা ফলের বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বীজ থেকে তৈরি করা চারা ফল ধরতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ বছর। গাছ বাঁচে ২৮ থেকে ৩০ বছর। শাখা কলম বা কাটিং করেও চালতার চারা তৈরি করা সম্ভব।
চালতা হার্ট ও লিভারের টনিক হিসেবেও কাজ করে। অনেকেই চালতাকে প্রকৃতির টনিক হিসেবে বলে থাকেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান তত্ত্ববিধ ড. প্রফের আব্দুর রহিম বলেন, চালতা পেটের ব্যথা বন্ধ করে, শরীরের তাপমাত্রা এবং নার্ভ সিস্টেম সতেজ রাখে। চালতা ফলের রসে জ্বর, কফ সারে। এছাড়া পাতা এবং গাছের ছাল আয়ুর্বের্দিক ওষুধে ব্যবহার করা হয়। খাদ্যের মধ্যে চালতা আচার, চাটনি তৈরিতে অদ্বিতীয়। এছাড়া চালতা গাছ থেকে আঠা পাওয়া যায়। চালতা গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি ফল। এর আচার অনেকের কাছে খুবই পছন্দনীয়। এ ফলের অনেক উপকারিতা আছে।
চালতাকে লিভার ও হার্টের টনিক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, চালতা প্রকৃতির ওষুধ। উপজেলার জন্মেজয় গ্রামের নুরুল ইসলাম (৬৫) বলেন, চালতা গাছ শুধু প্রকৃতির ওষুধ নয়, এটির আঠা নৌকায় ব্যবহার করা হয়। চালতা পাতার রস চিনি মিশিয়ে শরবত করে খেলে শরীরের জ্বালাপোড়া কমে। এর কাঠও অনেক শক্ত। তবে আমাদের দেশে অন্য গাছের সঙ্গে প্রকৃতির টনিক হিসেবে চালতা গাছ লাগালে ভালো হতো।