
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নির্বাচন পদ্ধতি। বিশেষ করে সামনে আসছে ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সম্ভাব্য সময় হিসেবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথাই বলছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রায় ১৫০টি রাজনৈতিক দল থেকে জমা পড়েছে নিবন্ধনের আবেদন। চলছে যাচাই-বাছাই এবং প্রতীক বরাদ্দের প্রস্তুতি।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার’ বিষয়টি। একদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির মতো কিছু রাজনৈতিক দল চাইছে সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক পদ্ধতি চালুর দাবি জানাতে। অন্যদিকে বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান করছে।
আনুপাতিক পদ্ধতি আসলে কী?
আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটাররা সরাসরি প্রার্থীর পরিবর্তে ভোট দেন একটি রাজনৈতিক দলকে। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায়, সংসদে তার প্রতিনিধিত্বও হয় সেই অনুপাতে। অর্থাৎ, যদি কোনো দল ১০ শতাংশ ভোট পায়, তবে সংসদেও তারা ১০ শতাংশ আসন পাবে। এককভাবে যদি কোনো দল ৫১ শতাংশ ভোট না পায়, তবে জোট সরকার গঠন করতে হয়।
এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনে একটি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা জমা দেয়, যা ভোটের ফল অনুযায়ী কার্যকর হয়। তবে এই তালিকা নির্বাচন চলাকালে গোপন থাকে এবং প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে সেখান থেকেই মনোনীতরা সংসদে প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশের প্রচলিত পদ্ধতি
বর্তমানে বাংলাদেশে যে নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত, তা হলো ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ভোটাররা সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেন। যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। এমনকি মাত্র এক ভোট বেশি পেলেও সেই প্রার্থী বিজয়ী হন। এই পদ্ধতির কারণে ছোট দলগুলো অনেক সময় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় না।
উদাহরণস্বরূপ, যদি চারজন প্রার্থীর মধ্যে একজন পান ২৫ শতাংশ ভোট, আর বাকি তিনজন করে ২০ শতাংশ পান, তবে সেই ৭৫ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্ব সংসদে থাকবে না। তবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে এই সব ভোট দলীয় মোট ভোটে যোগ হয়, যার ফলে ছোট দলগুলোরও সংসদে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
কোন কোন দেশে চালু রয়েছে আনুপাতিক পদ্ধতি?
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই বর্তমানে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রথম আনুপাতিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বেলজিয়ামে, ১৮৮৯ সালে। এরপর ১৯০৭ সালে ফিনল্যান্ড ও ১৯০৯ সালে সুইডেন এই পদ্ধতি গ্রহণ করে।
এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা ১৯৮৯ সাল থেকে আনুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে। দেশটিতে ২২টি জেলা ও ১৯৬টি আসনের পাশাপাশি রয়েছে বোনাস আসনের ব্যবস্থাও। নেপালে ২৭৫টি আসনের মধ্যে ১১০টি আসন নির্বাচিত হয় আনুপাতিক পদ্ধতিতে। সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে।
এছাড়া আলজেরিয়া, ব্রাজিল, চিলি, লেবানন, মরক্কো, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের ৭৩টিরও বেশি দেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে চালু হবে কি এই পদ্ধতি?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আনুপাতিক পদ্ধতি চালুর বিষয়টি অনিশ্চিত। এটি কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাংবিধানিক এবং আইনি সংশোধন। যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠে এবং সেই অনুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তবে আগামী নির্বাচনে এই পদ্ধতি চালু হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অন্যথায় বাংলাদেশে আগের মতোই চলবে প্রচলিত ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি।
আফরোজা