
ছবি: সংগৃহীত
ঐতিহাসিক নগরী দিরিয়াহের নাম উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সাহসিকতার ক্যানভাস—যেখানে মরুদ্বীপের বুকে জন্ম নিয়েছিল এক অটুট সংস্কৃতি, সংগ্রাম আর স্বাধীনচেতা স্বপ্নের গল্প। সৌদি আরবের প্রথম রাজধানী হিসেবে দিরিয়াহ শুধু একটি শহর নয়; এটি আরব জাতির আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু, একটি ইতিহাসের জীবন্ত প্রতীক। এখানেই ১৭৪৪ সালে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা পরবর্তীতে গোটা উপসাগরীয় অঞ্চলে এক ঐতিহাসিক পালাবদলের সূচনা করে।
ইতিহাসের গর্ভে অবস্থিত দিরিয়াহ এক জনপদ, যা আজ সৌদি আরবের জন্মকাহিনির অপরিহার্য অংশ। ১৮ শতকের মাঝামাঝি, ১৭৪৪ সালে মরুর বুকে গড়ে ওঠা এই শহরে সংঘটিত হয় এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক মৈত্রী, যখন স্থানীয় শাসক মুহাম্মদ ইবনে সৌদ এবং প্রভাবশালী ইসলামী সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহহাব একটি আদর্শিক ও কৌশলগত ঐক্যে পৌঁছান।
এ মিলন ছিল কেবল দুই ব্যক্তির নয়, বরং এটি ছিল ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যা পরবর্তীতে রূপ নেয় প্রথম সৌদি রাষ্ট্রে। দিরিয়াহ-ই হয়ে ওঠে সেই ঐতিহাসিক সূতিকাগার, যেখান থেকে সৌদ পরিবার এবং আধুনিক সৌদি আরবের দীর্ঘ ও গৌরবময় অভিযাত্রা শুরু হয়—একটি রাষ্ট্র, যার ভিত্তি ছিল ইসলামি মূল্যবোধ, সামাজিক শুদ্ধি এবং স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার।
দিরিয়াহ ছিল শুধু একটি শহর নয়, বরং এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও রাজনৈতিক কেন্দ্র, যা সৌদি আরবের ইতিহাসে একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলে। এর অবস্থান মরু পথের মাঝখানে হলেও, এখানে গড়ে উঠেছিল প্রশস্ত ও দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, দৃষ্টি নন্দনতত্ত্ব মসজিদ এবং মাড-ব্রিক (কাঁচা ইট) দিয়ে নির্মিত স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন যেগুলো তার সময়ের উন্নত নগরায়ণের পরিচয় বহন করে। এসব স্থাপনা প্রমাণ করে, দিরিয়াহ শুধুমাত্র প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিল না, বরং ছিল সাংস্কৃতিক বিকাশ ও শিক্ষারও এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। এখানকার স্থাপত্য ও নকশা, সামাজিক সংগঠন ও ধর্মীয় জীবন, সব মিলিয়ে এটি ছিল এক ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ নগরী, যা আজও আরব জাতির ইতিহাসে গৌরবের স্মারক হয়ে আছে।
দিরিয়াহর সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত অংশ হলো আত-তুরাইফ জেলা, যা ২০১০ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের মর্যাদা লাভ করে। এটি ছিল প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের শাসক পরিবারের বাসভবন এবং সেই সময়কার প্রশাসনিক কেন্দ্র। আত-তুরাইফ কেবল রাজনৈতিক গুরুত্বেই নয়, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এক অনন্য নিদর্শন।
এখানকার স্থাপত্যশৈলীতে ফুটে উঠেছে প্রাচীন "নাজদি" রীতির নিখুঁত প্রকাশ—যার বৈশিষ্ট্য হলো মোটা কাদামাটির দেয়াল, সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা কাঠের দরজা, দৃষ্টিনন্দন জ্যামিতিক অলংকরণ, সালওয়া প্রাসাদ, সৌদি রাজপরিবারের আদি আবাস, ইমাম মুহাম্মদের মসজিদ, বুরুজ ও প্রহরাকক্ষের ধ্বংসাবশেষসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনে দর্শনার্থীদের রিদয় কাড়ে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত গুরুত্বে দিরিয়াহ
শহরের গঠন ও বিকাশের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ওয়াদি হানিফা নামের দীর্ঘ ও বিস্তৃত এক শুকনো নদীখাত। যদিও বছরের বেশিরভাগ সময় এটি পানিশূন্য থাকে, তবে অতীতে এটি ছিল কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। নদীখাতের আশেপাশের উর্বর ভূমি ও পানির মৌসুমি প্রবাহ এখানকার খেজুর বাগান ও ফসলের চাষে অবদান রেখেছিল। তবে শুধু কৃষির দিক থেকেই নয়, এই অঞ্চলটি ছিল এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের আধার—নদীখাতের গভীরতা ও আশপাশের উচ্চভূমি মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক প্রাকৃতিক শীতলতা, যা মরু আবহাওয়ার মধ্যে এনে দিত এক স্বস্তিদায়ক পরিবেশ।
এই এলাকায় ছড়িয়ে থাকা খেজুরবাগান শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, আশেপাশের প্রাকৃতিক গুহা ও বৃক্ষরাজি ছিল নানা প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এভাবে দিরিয়াহ পরিণত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক মিলনের স্থানে—যেখানে সভ্যতার গতি ও প্রকৃতির ছায়া একসঙ্গে পথচলা করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
সৌদি আরবের Vision 2030 উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঐতিহাসিক দিরিয়াহকে এক নতুন রূপে গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো একে একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন হাবে রূপান্তর করা। এই লক্ষ্য পূরণে গৃহীত হয়েছে ‘দিরিয়াহ গেইট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’—যার মাধ্যমে এখানে গড়ে উঠছে বিশ্বমানের বিলাসবহুল হোটেল, আধুনিক রেস্তোরাঁ, জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
এছাড়াও, প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে চলছে সংরক্ষণের কাজ, যাতে করে ইতিহাসের ছোঁয়া বজায় থাকে। একইসাথে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে ‘জীবন্ত ইতিহাস’ উপস্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, যেখানে দর্শনার্থীরা অতীতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন একটি আধুনিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এই প্রকল্প কেবল পর্যটন নয়, বরং সৌদি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়কে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার একটি বড় পদক্ষেপ।
এটি সৌদি আরবের জাতীয় আত্মপরিচয় ও আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। এখান থেকেই ১৮ শতকে মুহাম্মদ ইবনে সৌদ ও ইসলামী সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহহাবের ঐতিহাসিক ঐক্যের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়, যা পরবর্তীতে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই ঐতিহাসিক শহরকে ঘিরেই সৌদি জাতির আত্মপরিচয়ের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে।
দিরিয়াহ শুধুই পুরনো ইট-পাথরের শহর নয়; এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যা একটি জাতির জন্ম, আত্মত্যাগ, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের গল্প বহন করে। এই নগরী যেন সৌদি আরবের হৃদয়ের স্পন্দন, যেখানে প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ, প্রতিটি মাটির দেয়াল সাক্ষ্য দেয় একটি গৌরবময় অতীতের। আত-তুরাইফের পুরনো প্রাসাদ ও মসজিদের পাশে দাঁড়ালে মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে—চারপাশে শুধু ইতিহাসের নিঃশব্দ গুঞ্জন। আপনি যদি সেখানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করেন, তাহলে অনুভব করবেন—এই নিস্তব্ধ দেয়ালগুলো যেন ফিসফিস করে বলছে: “আমরা ছিলাম, আছি, এবং ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করছি…”
দিরিয়াহ আজ আর শুধুই একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, এটি সৌদি জাতির আত্মপরিচয়ের উৎস, যেখানে অতীত ও আধুনিকতা একসাথে পথ চলে। প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধূলিকণা যেন বলে যায় একটি জাতির সংগ্রামী উত্থানের কথা—যা আজও অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতুন প্রজন্মের সামনে।
আঁখি