
২০২৪ সালের জুলাই মাসজুড়ে চলা ছাত্র ও নাগরিকদের ‘গণঅভ্যুত্থান’ কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে শেরপুর জেলাজুড়ে। সাধারণ শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সচেতন জনগণ, তাদের একত্রিত কণ্ঠে প্রতিবাদ ওঠে বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে।
কিন্তু ৪ আগস্টে শেরপুর শহরে সংঘটিত ঘটনাটি আন্দোলনের গতি ঘুরিয়ে দেয়। সেই দিন গাড়ি চাপায় ও গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন ছাত্র শহীদ হন। আহত হন আরও অন্তত ৫০ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন দায়সারা কিছু পদক্ষেপ নিলেও, শহীদ পরিবারের দায়ের করা হত্যা মামলা গুলোর বিচার প্রক্রিয়া আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে।
আন্দোলনের সার্বিক চিত্র:
শেরপুর সদর, নকলা, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতীতে একযোগে ছাত্রদের মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে ১৭ থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত।
তাদের ৫ দফা দাবির মধ্যে ছিল:
- সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমুক্ত নিয়োগ,
- রাজনৈতিক নিপীড়ন বন্ধ ছাত্রদের,
- অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা,
- আন্দোলনে হতাহতদের বিচার,
- গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৪ আগস্ট বিকেলে শহরের তিনানী বাজার এর কলেজ মোড়ে ছাত্রদের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে মুখোমুখি হয় ছাত্র-জনতা ও শাসকদল সমর্থকদের একটি মিছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, উসকানিমূলক স্লোগান, ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে ও জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি চাপায় ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত হন। পরে হাসপাতালে আরও একজন মারা যান।
শহীদ ও আহতদের পরিচয় ও অবস্থা:
১. মাহবুব আলম (২১)
-
ঠিকানা: বটতলা, পাকুড়িয়া, শেরপুর সদর
-
পরিচয়: কলেজছাত্র ও আইটি উদ্যোক্তা
-
মৃত্যু: ঘটনাস্থলেই গুলিতে
২. শারদুল আশীষ সৌরভ (২২)
-
ঠিকানা: পাইকুড়া, ঝিনাইগাতী
-
পরিচয়: কলেজছাত্র
-
মৃত্যু: ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির চাপায়
৩. সবুজ হাসান (২৩)
-
ঠিকানা: খরিয়া কাজীর চর, শ্রীবরদী
-
পরিচয়: ছাত্রদল কর্মী
-
মৃত্যু: গুলিতে
আহতদের মধ্যে ১৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ ও ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়।
জেলা প্রশাসন ৪৪ জনকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে (প্রতি জন ৫-১০ হাজার টাকা), শহীদ পরিবার পেয়েছে আনুমানিক ৩.৫–৪ লাখ টাকা করে।
মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়ার স্থবিরতা:
মামলা নং GR-476/24 (সদর)
-
বাদী: মাহবুব আলমের মা মাহফুজা খাতুন
মামলা নং GR-479/24 (শ্রীবরদী)
-
বাদী: সবুজ হাসানের বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন
অভিযোগ ধারা: ৩০২, ৩২৬, ১১৪, ৩৪ দণ্ডবিধি
নামীয় আসামি: স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্রলীগ কর্মীসহ মোট ৩৮ জন
অজ্ঞাত আসামি: প্রায় ২০০ জন
আদালতের মন্তব্য (১৮ অক্টোবর ২০২৪):
“গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ আসামি পলাতক। তদন্তে গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
পুলিশি পদক্ষেপ:
এজাহারভুক্ত আসামিদের অধিকাংশ পলাতক, একাধিক অভিযান হলেও কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই গ্রেপ্তার দেখাতে পারেনি পুলিশ। শহীদ পরিবারের অভিযোগ, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ ও হুমকি অব্যাহত।
মাহবুবের মা, মাহফুজা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, “আমি আদালতে দাঁড়িয়ে শুধু একটা কথাই বলেছি, আমার ছেলেকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই। কিন্তু একবছরেও কিছু হলো না।”
সবুজের ভাই, সাদ্দাম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, “আমার ভাই কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। তাকে যেভাবে গুলি করা হয়েছে, তা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না।”
এব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট এম কে মুরাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, “এই মামলা গুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা বিচারহীনতার চিত্র তুলে ধরছে।”
শেরপুরে জুলাই আন্দোলনের শহীদরা এখন কেবল কিছু স্মরণীয় নাম নয়, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিরোধের প্রতীক। কিন্তু তাদের হত্যাকারীদের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। এই রাষ্ট্র কি কেবল শক্তিধরদের পক্ষেই? শহীদ পরিবার, সাধারণ মানুষ ও ছাত্রসমাজের একটাই দাবি, বিচার চাই, প্রতিশোধ নয়।
নুসরাত